রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বার্ন ইউনিটে শুধুই আর্তনাদ

আলী আজম

আশিকের বয়স ১২ বছর। সে কারখানার শ্রমিক নয়। তবে কারখানার পাশেই পরিবারের সঙ্গে থাকত। স্থানীয় একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। ভোরে ঘুম থেকে জেগে প্রস্রাব করতে বাইরে বের হয়। এ সময় বিকট শব্দে কোনো কিছু ছিটকে এসে তার গায়ে পড়ে। এতে তার মাথা, দুই পা, এক হাত ও এক চোখ মারাত্মক জখম হয়। ওর ভাই আনোয়ার বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর ওরে দেখে মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্ন দেখেছে। তাড়াতাড়ি ধরে টঙ্গী হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা সোয়া ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।’

আশিকের বাবা মোহাম্মদ রনি বলেন, তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আশিক দ্বিতীয়। শুক্রবার রাতে গরু কেনা নিয়ে বাসায় আলোচনা হয়। এতে আশিক ব্যাপক খুশি হয়েছিল। আজ (গতকাল) গরু কেনার কথা ছিল। ঈদের আগে ছেলের এমন মৃত্যু, ভাবতেই পারিনি।

মৃত দেলোয়ার হোসেন (৪৫)-এর ভাতিজা লোকমান হোসেন বলেন, ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় ১৮-১৯ বছর ধরে সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন দেলোয়ার। তার জেবুন্নাহার, জোসেফ, জুয়েল ও সুমাইয়া নামে চার সন্তান রয়েছে। তিনি টঙ্গীর স্টেশন রোডে থাকলেও পরিবার থাকত শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বড় পোড়াঘর গ্রামে। পরিবারপ্রধানকে হারিয়ে পরিবারসহ স্বজনদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

মৃত তাহমিনা আক্তার (২০) পাকিজা গ্রুপে কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মারুফ বিল্লাহ বলেন, তাহমিনা ছুটি নিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। তার বাবার নাম হাবিবুর রহমান। বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আদমপুর গ্রামে। মৃতের বোন সীমা অ্যাপারেলসের শ্রমিক রোজিনা বলেন, ভোরে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে যেতে রিকশায় উঠি। কিছুক্ষণ পরই দুর্ঘটনার শিকার হন তাহমিনা। তাদের পরিবারে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে শোক নেমে এসেছে।

মৃত আনোয়ার হোসেন (৪০)-এর স্ত্রী আকলিমা খাতুন বলেন, ওই কারখানার গাড়িচালক ছিলেন আনোয়ার। মীম (১৮) ও হাবিবা (১৫) নামে তাদের দুই সন্তান রয়েছে। তারা দক্ষিণ বাড্ডার ক-১১২/৪ নম্বর বাসায় থাকেন। বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষা গ্রামে। মৃত অহিদুজ্জামান স্বপন (৩০)-এর স্ত্রী আমিরুন্নেসা ইতি বলেন, দুই বছর ধরে স্বপন ওই কারখানায় অপারেটর হিসেবে চাকরি করছেন। তাদের ইকরা (৫) ও ইলা (২) নামে দুই সন্তান রয়েছে। তারা উত্তরখানের মান্ডা এলাকায় থাকতেন। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালিতে। স্বপনের শ্যালক আরিফ বলেন, স্বপন বেতন পেলেও বোনাস পাননি। আজ (গতকাল) বোনাস দেওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল পরিবার নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করতে বাড়ি যাবেন। বাড়ি ঠিকই যাচ্ছেন তবে লাশ হয়ে— এ কথা বলেই আরিফ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

ওই কারখানায় পেইন্টিং সেকশনে কর্মরত মীর শিপনের স্ত্রী আবিদা সুলতানা বলেন, কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে শিপন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে টঙ্গী হাসপাতাল হয়ে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তার অবস্থা খারাপ দ্রুত সিটি স্ক্যান করাতে হবে। কিন্তু ঢামেক হাসপাতালের সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট থাকায় দিশাহারা হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। শিপনের সারা শরীরে আঘাত, নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। পরে কয়েকজন শিপনকে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলে বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করিয়ে আনা হয়।

ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি জাহাঙ্গীর মৃধা, আমিনুল ইসলাম রিজু, জাকির হোসেন, আশিক রহমান ও রোকনের পরিবার বলছে, আহতরা মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত। চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে দেখে তাদের দ্রুত সিটি স্ক্যান করাতে বলেন। কিন্তু জানা গেল ঢামেক হাসপাতালের সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট। পরে অ্যাম্বুলেন্সযোগে দ্রুত তাদের আশপাশের ক্লিনিক ও হাসপাতালে নিয়ে সিটি স্ক্যান করানো হয়। এত বড় হাসপাতালে সিটি স্ক্যান মেশিন না থাকায় তারা বিস্মিত হন।

ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ হাসপাতালের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান তিন মাস ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিন বিদেশ থেকে আনতে সময়ের প্রয়োজন। তবে এতে চিকিৎসাসেবার কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। আশপাশের সরকারি হাসপাতালে থেকে এগুলো করানো হচ্ছে।

ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানার পাশে ফেলটেক্স গার্মেন্টের আয়রনম্যান মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ভোরে কারখানার পাশের একটি মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরিফ পড়ছিলাম। ৫টা ৪২ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে মসজিদ কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্প হয়েছে মনে করে দ্রুত বাইরে বের হয়ে আসি। দেখি এক ব্যক্তি ভাঙা হাত নিয়ে মসজিদের দিকে দৌড়ে আসছেন। তাকে দ্রুত টঙ্গী হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে একে একে আটজনকে উদ্ধার করি। এদের মধ্যে গুরুতর স্বপন নামে এক ব্যক্তিকে টঙ্গী হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বপন মারা যান। দুপুরে ঢামেক মর্গের সামনে শরীফের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তার পরিধেয় বস্ত্র রক্তাক্ত ছিল। শরীফ ছোট হলেও তার কাজের প্রশংসা করেন মৃত স্বপনের স্বজনরা।

ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানার বেশ দূরে থাকেন রুবেল নামে এক শ্রমিক। ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে দ্রুত রাস্তায় বের হয়ে আসেন। দেখতে পান ওই কারখানায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কাছে যেতেই শ্রমিকদের আর্তচিৎকার শুনতে পান। আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারে ছুটে আসেন স্থানীয়রা।

ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান বলেন, রোগীদের সারিয়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। আহতদের মধ্যে রিপন দাস (২২) নামে একজনের শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকে বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। টঙ্গীর ঘটনায় ঢামেক হাসপাতালে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে এবং চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৭ জন। ঘটনাস্থল থেকে ঢামেক হাসপাতাল মর্গে ১৯ জনের লাশ এসেছে বলেও তিনি জানান।

সর্বশেষ খবর