বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

টিলাশূন্য হচ্ছে সিলেট

আলিশান বাড়ি-স্থাপনা নির্মাণ ক্ষতি প্রকৃতি ও পরিবেশের

জিন্নাতুন নূর, সিলেট থেকে ফিরে

টিলাশূন্য হচ্ছে সিলেট

সিলেটের বিয়ানীবাজারের পাটনগ্রামে টিলার মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে —জয়ীতা রায়.

পাহাড়-টিলা বেষ্টিত মনোরম অঞ্চল সিলেট। কিন্তু এই সিলেট এখন টিলাশূন্য হওয়ার পথে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এবং অসাধু ব্যক্তি সিলেটে নির্দ্বিধায় একের পর এক টিলা কেটে ফেলছেন। কোনোভাবেই তাদের থামানো যাচ্ছে না টিলা কাটা থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই টিলাখোররা কৌশল পাল্টে এখন ভরা বর্ষায় ও রাতের আঁধারেও টিলা কাটছেন। সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন উভয় ধরনের টিলা কেটে টিলাখোররা তৈরি করছেন আলিশান বাড়ি ও রিসোর্ট। তারা বালুর বিকল্প হিসেবে ট্রাকে ট্রাকে এ টিলার মাটি আবাসিক প্রকল্প তৈরির কাজে বিক্রি করছেন।

একসময় সিলেটের শাহি ঈদগাহ, টিবি গেট, বালুচর, বিমানবন্দর এলাকা, মেজরটিলা, খাদিমপাড়া, লাক্কাতুরা, শাহপরান, বটেশ্বর, পাঠানটুলা ইত্যাদি এলাকায় প্রচুর পাহাড় ও টিলা ছিল বলে স্থানীয়রা জানান। সিলেটের পরিবেশবাদীরা আশঙ্কা করছেন, যে হারে টিলা কাটা হচ্ছে তাতে সিলেট অচিরেই টিলাশূন্য হয়ে পড়বে। এ ছাড়া টিলা কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাড়ি তৈরির ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুঝুঁকি। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত সিলেট সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ছয় উপজেলায় পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। উপজেলাগুলো হচ্ছে সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোলাপগঞ্জ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিয়ানীবাজারের ছোটদেশ গ্রামের বেশ কটি টিলা কেটে আলিশান বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু টিলা মালিক ট্রাকে ট্রাকে টিলার মাটি বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির কাছে বিক্রি করছেন। জানা যায়, বালুর বিকল্প হিসেবে সিলেটে টিলার মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এজন্য এর কদরও বেশি। সাধারণত সিলেটে ফুট হিসেবে টিলা বিক্রি হয়। আর একেকটি টিলা কমপক্ষে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বিয়ানীবাজারের পাটন গ্রামেও চলছে টিলা কাটার প্রতিযোগিতা। প্রবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামে টিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে সব আলিশান বাড়ি। ৫ থেকে ৮ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এসব বাড়ি। গ্রামের ‘বাংলাবাড়ি’তে গিয়ে দেখা যায়, টিলা কেটে দোতলা বিশাল অট্টালিকা তৈরি করা হয়েছে। এখনো টিলার ছোট কিছু অংশ বাড়ির আশপাশে রয়ে গেছে। বাড়ির ছোট ছেলে আবদুল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তাদের এই গ্রামে দুটি টিলার মধ্যে একটিতে বাড়ি বানিয়েছেন। অন্যটি এখনো কাটা হয়নি। প্রয়োজন হলে সেটিও কেটে মাটি বিক্রি করবেন। একই গ্রামে আরেকটু সামনে যেতেই চোখে পড়ে বিশাল একটি টিলার গাছ কেটে সাবাড় করেছেন সেই টিলার মালিক। এমনকি আগাছা পরিষ্কারের জন্য তিনি টিলায় আগুনও দিয়েছেন। এরই মধ্যে টিলার একটি অংশ কাটা শুরু হয়েছে। তবে শুধু বসতবাড়ি নয়, টিলা কেটে সিলেটে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল সব রিসোর্টও। সিলেট শহর ও তার বাইরে বিশেষ করে শ্রীমঙ্গলে টিলা কেটে রিসোর্ট তৈরির হার বেশি। শ্রীমঙ্গল এলাকার লাউয়াছড়া উদ্যান পেরিয়ে রাধানগর ঘুরে দেখা যায়, এ এলাকায় বেশ কটি রিসোর্ট টিলা কেটে ও চা বাগানের ওপর তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান ও নভেম ইকো রিসোর্ট।

এ ছাড়া গোটা সিলেট শহরে এখন আর তেমন টিলা দেখতে পাওয়া যায় না। শহরের বেশির ভাগ টিলা কেটে আবাসিক এলাকা বানানো হয়েছে। সিলেটের শাহপরান উপজেলার খাদিমগড়ে অবস্থিত শুকতারা রিসোার্টটি পাহাড়ি টিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে। গিয়ে দেখা যায়, বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি করা এ রিসোর্টের পুরোটিই বিশাল টিলার ওপর বানানো। টিলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অতিথিদের জন্য তৈরি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি কক্ষ। এখানে আরও আছে রেস্টুরেন্ট, সুইমিং পুল, সূর্যোদয় দেখার স্থান। নাজিমগড় রিসোর্টের ঠিক পাশেই বর্তমানে আরেকটি টিলা কেটে বাড়ি তৈরির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পরিবেশবাদীরা জানান, টিলা কাটায় উচ্চ আদালতের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই টিলাখোররা কৌশল পাল্টে এখন রাতের আঁধারে টিলা কাটছেন। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই টিলা কাটা শুরু হয়। বর্ষায় পাহাড়-টিলার মাটি নরম হয়ে আসে। সে সময় অসাধুরা কৌশলে টিলার মাটি কেটে রাখে। এতে টিলা ধসে পড়ে। পরে টিলার মাটি চলে যায় বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানির কাছে। সিলেট অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল স্টেট গ্রুপের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য, সিলেটের ২৫টি আবাসন প্রকল্পের অর্ধেকই টিলা এলাকায় অবস্থিত। গত এক দশকের বেশি সময়ে টিলা ধসে সিলেটে ৩০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়। টিলা কাটার জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও নগণ্য। পরিবেশ অধিদফতরকেও এ ব্যাপারে খুব একটা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। সম্প্রতি কোম্পানীগঞ্জে শাহ আরেফিন টিলাসংলগ্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি টিলা থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের সময় ধসে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া একই এলাকার মতিন টিলা ধসেও পাঁচজন শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, ‘পাহাড় ও টিলা কাটা নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাও আছে। পাহাড়-টিলা কেটে অবৈধ পথে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরা ব্যর্থ। তিনি আরও বলেন, এ-সংক্রান্ত কাজে সিলেটে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখলে পরিবেশ ধ্বংস ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত অনেককে চিহ্নিত করা যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর