রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

পরিবহনে চাঁদাবাজি থামছেই না

বিআরটিএর ঝক্কি, পুলিশি মাসোহারা, সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, রেকার বাণিজ্য-ফিটনেসের ধকল, গাড়ি মালিকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত

সাঈদুর রহমান রিমন

পরিবহনে চাঁদাবাজি থামছেই না

পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে নজিরবিহীনভাবে। চাঁদাবাজদের অপতত্পরতা রোধে র‌্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। পুলিশ, সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সংঘটিত পরিবহন চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসনিক সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে এ চাঁদাবাজি এখন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে। এক শ্রেণির পরিবহন শ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সম্মিলিত চাঁদাবাজ চক্র। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে যানবাহন চালক, মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। চাঁদাবাজির অত্যাচার নিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন রুটে পরিবহন ধর্মঘট পর্যন্ত হয়েছে। তবু চাঁদাবাজির ধকল থেকে রেহাই মিলছে না।

সন্ত্রাসীরা সরাসরি ‘চাঁদা’ তুললেও পরিবহন শ্রমিকরা চাঁদা নেয় শ্রমিক কল্যাণের নামে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা টাকা তোলে মাসোহারা হিসেবে। এ ছাড়া আছে রেকার ভাড়া, রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামের অবৈধ চার্জ। এমন নানা নামে, নানা কায়দায় চলছে এ চাঁদাবাজির উৎসব। রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। সায়েদাবাদ-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী একাধিক মিনিবাস চালক বলেন, নানামুখী চান্দা-ধান্ধার কবলে চালক, মালিক, শ্রমিক সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যাত্রীরা হচ্ছেন নানা দুর্ভোগের শিকার। মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদসহ সব বাস-ট্রাক টার্মিনালের অবস্থাই অভিন্ন। এসব স্থানে গাড়ি ঢুকতেও টাকা লাগে, বেরোতেও লাগে টাকা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে পুলিশের চাঁদাবাজি। রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কের যত্রতত্র পুলিশের বিশেষ চেকিং আর মাসোহারা আদায়ের প্রতিযোগিতা বন্ধের সাধ্য যেন কারোর নেই। রাজধানীর একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে ট্রাকপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা গুনতে হয়।  ট্রাকচালকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আগে সাধারণত ঢাকার যে কোনো একজন সার্জেন্টকে ১০০ টাকা দিয়ে স্লিপ সংগ্রহ করলে সিটির মধ্যে আর কোথাও পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো না। কিন্তু বর্তমানে এক সার্জেন্ট অন্য সার্জেন্টের স্লিপকে পাত্তা দেয় না, আলাদা আলাদাভাবেই টাকা দিতে হয়।

চাঁদাবাজির নানা ধরন : থানার চাঁদা, ফাঁড়ির চাঁদা, বোবা চাঁদা, ঘাট চাঁদা, স্পট চাঁদা; পুলিশের মাসোহারা, মালিক-শ্রমিকের কল্যাণ ফি; রুট কমিটি-টার্মিনাল কমিটির চাঁদাও চলে বাধাহীনভাবে। সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে পুলিশের টোকেন বাণিজ্য। বাণিজ্যিক পরিবহনে নানা নামে নানা ঢঙে চাঁদাবাজি চলে। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সায়েদাবাদ থেকে দেশের পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৪৭টি রুটে চলাচলরত দুই সহস্রাধিক যানবাহন থেকে প্রতিদিন ফ্রি স্টাইলে চলছে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ ৩২টি রুটে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ কোচ চলে। এ ছাড়া রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী, উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালীগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলির অন্যান্য রুটে সহস্রাধিক বাস-মিনিবাসের চলাচল রয়েছে। বাস-মিনিবাসের চালক ও শ্রমিকরা জানান, চাঁদা না দিয়ে কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে বাইরে বের করার সাধ্য কারও নেই। চাঁদা নিয়ে টুঁশব্দ করলে নির্যাতনসহ টার্মিনাল ছাড়া হতে হয়। রাজধানী থেকে চলাচলকারী দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে এবং লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা জানান, নানা রকম কমিটির দখলদারিত্ব আর মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজির অত্যাচারে মালিকরা পথে বসতে চলেছেন। শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে।  নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাস মালিক বলেন, লাকসাম, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন রুটে এখন গাড়িপ্রতি ১২৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদাবাজির শিকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিদিন চাঁদা প্রদানের বিস্তারিত তালিকা তুলে জানান, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০ টাকা, মালিক সমিতি ৮০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ৪০ টাকা, টার্মিনাল কমিটি ২০ টাকা, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০ টাকা, কেরানির ভাতা ২০ টাকা, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ টাকা এবং একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।  পরিবহন মালিকরা অভিযোগ করেন, যমুনা সেতুর দুই প্রান্তে ও গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে সরকারি দলের নেতা-পাতি নেতা, কর্মী-ক্যাডার নামধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও পুলিশের অসাধু সদস্যরা চাঁদাবাজি করে আসছে। রাজশাহী থেকে একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকায় আসতে প্রতি ট্রিপে দেড়-দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। যেসব জেলা পেরিয়ে আসতে হয়, সেসব জেলায় মাসিক ভিত্তিতে পুলিশ সার্জেন্টদের ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এর বাইরে থানা-ফাঁড়ির পুলিশদেরও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়াও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন শ্রমিক ও মালিক সংগঠন-সমিতিকেও পয়েন্টে পয়েন্টে চাঁদা দিয়ে পরিবহন ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুধু রাজশাহী অঞ্চলেই নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সমানভাবে চলছে। আরেকজন পরিবহন ব্যবসায়ীর বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার সায়েদাবাদ নতুন রাস্তা, মাওয়াঘাট, ভাঙ্গায় পুলিশ সার্জেন্টদের নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদার টাকা দিতে হয়। মাসিক চাঁদার টাকা না দিলে নানা সাজানো মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।

ট্রাক থেকেই কোটি টাকা : বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে পুলিশ। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এর প্রতিবাদ করলে হয়রানি আরও বেড়ে যায়। দেশে প্রতিদিন ৯০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল করে। এর কোনোটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না। তিনি বলেন, সড়ক বা মহাসড়কে এই ট্রাক চলাচল করতে গিয়ে একেকটি স্পটে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা যেমন হাইওয়ে পুলিশ নেয়, তেমনি মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামেও আদায় করা হয়। তবে চাঁদাবাজি নিশ্চিত করতে গিয়ে যেসব প্রশাসনিক হয়রানি চালানো হয়, এতে ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

টোলবাজির চাঁদায় অতিষ্ঠ : দেশের বিভিন্ন পৌরসভার প্রবেশ পথে পণ্য পরিবহনে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। বাঁশকল কিংবা টোলঘর বসিয়ে আদায় করা হচ্ছে এ চাঁদা। মন্ত্রণালয় থেকে বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পরও তা থামছে না। যেসব পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ট্রাক টার্মিনাল রয়েছে, সেগুলোতে টার্মিনাল টোল আদায়ের বিধান রয়েছে। যেখানে টার্মিনাল নেই সেখানে টোলের নামে চাঁদাবাজি সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু বেশ কিছু পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে বাঁশকল ও টোলঘর বসিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, নরসিংদীর মাধবদীতে ৫০ টাকা, রংপুর বাইপাসে ৫০ টাকা, ঝিনাইদহ পুলিশ লাইনের কাছে ৩০ টাকা, বাগেরহাট বড় বাজারের সামনে ৬০ টাকা, মাদারীপুর শহরের প্রবেশ পথে ৮০ টাকা, রাজৈর পৌরসভার নামে টেকেরহাটে ৬০ টাকা, গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইনের পাশে রাস্তার ওপর টোলঘর বসিয়ে ৫০ টাকা ও যশোরে গাড়িপ্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদাবাজি চলছে।

পরিবহন নেতারা বললেন : বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান বলেন, রাজধানী ও বাইরে পুলিশের চাঁদাবাজিতে পরিবহন মালিকরা এখন অতিষ্ঠ। এর প্রতিবাদে তারা সমাবেশ করেছেন। সরকারের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মাহমুদুল আলম মন্টু বলেন, রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামলেই চাঁদা দিতে হয় পুলিশকে। এর জন্য মৌখিক ও লিখিতভাবে সরকার ও পুলিশের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। শ্রমিক নেতারা জানান, কখনো ফিটনেস না থাকা, কখনো রং চটে যাওয়ার অজুহাতে গাড়ি আটক করে পুলিশ টাকা আদায় করছে।

সর্বশেষ খবর