শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

বাদল রহমানের কথা মনে পড়ে

ইমদাদুল হক মিলন

বাদল রহমানের কথা মনে পড়ে

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম। গল্পের নাম ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’। ’৯০ সালের কথা। ‘কিশোর তারকালোক’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা। কাঁটাবনের ওখানে অফিস, প্রেস। পত্রিকার যিনি মালিক, আরেফিন বাদল, তিনি ‘তারকালোক’ নামে একটি পাক্ষিক বিনোদন পত্রিকা বের করেন, ‘আগামী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও বের করেন। ‘কিশোর তারকালোক’ তাঁর নতুন প্রজেক্ট।  আমাকে নিয়েছেন সম্পাদক হিসেবে। ‘আগামী’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। আমাকে বলা হলো গল্প লিখতে। বেশ কিছুদিন ধরে মাথায় ঘুরছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গল্প লিখব। বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষরাও যে বঙ্গবন্ধুকে কতটা ভালোবাসেন এরকম একটা বিষয় নিয়ে লিখব। ‘কিশোর তারকালোক’ অফিসে বসে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা লিখে শেষ করলাম ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’। পদ্মার ওপারের বহুদূরের এক নিভৃত গ্রাম উদয়পুর। সে গ্রামের ভাগচাষি রতন মাঝি। মাঝি হচ্ছে তাদের পদবি। একেবারেই মাটির মানুষ, গ্রামের খেটে খাওয়া দরিদ্রজন। নিজের জমি নেই। অন্যের জমি ভাগে চাষ করে বলে ভাগচাষি। বঙ্গবন্ধুকে প্রচ  ভালোবাসে রতন। বাড়ির লাগোয়া কয়েক কদম জমিতে ‘কালোজিরা ধান’ নামের অতি সুস্বাদু চিড়া হয় এমন কিছু ধান লাগিয়েছিল সে। ধানটা হওয়ার পর তার কৃষাণী অতিযতেœ সেই ধান থেকে দেড়-পৌনে দুই সেরের মতো চিড়া তৈরি করেছে। রতনের ইচ্ছা এই চিড়াটুকু সে তার প্রিয়নেতার জন্য নিয়ে যাবে। নেতাকে দুচোখ ভরে একবার দেখবে, তাঁর পায়ের কাছে নামিয়ে রাখবে চিড়ার পোঁটলা, আর সেই ফাঁকে নেতার পা একটু ছুঁয়ে তার শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাবে, নিজের জীবন ধন্য করবে। অতিকষ্টে রাস্তা খরচ জোগাড় করে, চিড়ার পোঁটলা বুকের কাছে ধরে আগস্ট মাসের এক মধ্যরাতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তার বাড়ি থেকে লঞ্চঘাট পাঁচ-সাত মাইল। লঞ্চ ছাড়ে একেবারে ভোরবেলা। ভোরবেলার লঞ্চ ধরবে রতন। এই কারণে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এভাবে ঢাকায় এসে পৌঁছাল সে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে নেতার বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। এতরাতে নেতাকে সে কী করে দেখবে? ভাবল এই বাড়ির সামনেই সারারাত বসে থাকবে। সকালবেলা নেতা যখন বেরোবেন তখন দুচোখ ভরে তাঁকে দেখবে রতন, চিড়ার পোঁটলা পায়ের কাছে নামিয়ে নেতার পা স্পর্শ করবে। পুলিশ সন্দেহ করল রতনকে। ধরে নিয়ে গেল থানায়। পুলিশ অফিসার তাকে জেরা করতে লাগল। রতন সরল ভঙ্গিতে বলে গেল সবকথা। অফিসার হাসলেন। নেতাকে দেখতে এসেছ মানে কী? নেতাকে তুমি চেন? নেতা তোমাকে চেনেন? রতন অমায়িক মুখ করে বলল, নেতাকে কে না চেনে সাহেব? তাঁরে চিনব না, এ হয় নাকি! নেতাও তো দেশের সব মানুষকেই চেনেন। মুখখানা দেখলে আমাকেও চিনবেন। আমিও তো দেশের মানুষ। পোঁটলায় কী? চিড়া। খুব ভালো চিড়া সাহেব। বাড়ির লাগোয়া একচিলতে জায়গায় কালিজিরা ধান হয়েছিল। খুব অল্প হয়েছিল। পৌনে দুই সেরের মতো চিড়া হয়েছে। চিড়াটা সাহেব নেতার জন্য নিয়ে এসেছি। নেতা একমুঠ মুখে দিলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে আমার। আমি নেতাকে বড় ভালোবাসি। গরিবের ভালোবাসা নেতাকে কেমন করে জানাব! ম্যালা দিনের স্বপ্ন ছিল তাঁরে একবার সামনাসামনি দেখব। পায়ের কাছে চিড়ার পোঁটলাটা নামিয়ে রেখে পা দুখানা একবার ছুঁয়ে দেব। আমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাব। রতন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আর হলো কই! আপনার লোকজন ধরে নিয়ে এলো। আমি একটাও মিথ্যা বলি নাই সাহেব। মানুষ গরিব হতে পারি কিন্তু ভালোবাসাটা খাঁটি। আমাদের মতো গরিব মানুষরাই নেতাকে বেশি ভালোবাসে।

পুলিশ অফিসার একদমই বিশ্বাস করলেন না রতনের কথা। প্রচ  ধমক দিলেন। বুক থেকে চিড়ার পোঁটলা ছিনিয়ে নেওয়া হলো কেমিক্যাল টেস্টে পাঠাবার কথা বলে, আর রতনকে পোড়া হলো লকাপে। রতনের মুখে তারপর আর কথা নেই। পাথর হয়ে গেছে সে। লকারে রাতভর বসে রইল এমন ভঙ্গিতে যেন সে কোনো মানুষ নয়, যেন সে সত্যি সত্যি পাথর।

ভোরবেলা গুঞ্জন উঠল থানায়। ছুটাছুটি, চাপা ফিসফাস। খানিকপর সেই দুজন পুলিশ এসে লকার খুলল। রতনমাঝি, বেরোও।

একজন পুলিশের প্যান্টের দুপকেট বেশ ফোলা। রতন নিঃশব্দে লকআপ থেকে বেরোল। পুলিশ দুজন ঠেলে ঠেলে তাকে এনে দাঁড় করাল সেই অফিসারের সামনে।

অফিসার দুঃখী মুখ করে চেয়ারে বসে আছেন। চোখে উদাসীনতা। রতনকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন। গভীর দুঃখের গলায় বললেন, নেতা কাল রাতে নিহত হয়েছেন। তোমাকে সন্দেহ করে তোমার ওপর আমি অবিচার করেছি ভাই। যাও, বাড়ি যাও। পকেট ফোলা পুলিশটি তখন তার প্যান্টের পকেট থেকে চিড়া বের করে অবিরাম মুখে পুড়ছে। রতন বুঝে গেল এই সেই চিড়া, ভালোবেসে বহুদূর থেকে নেতার জন্য নিয়ে এসেছিল সে। কালোজিরা ধান কত যতেœ বুনেছিল বাড়ির সামনে। সেই ধান শুকিয়ে কত যতেœ চিড়া কুটে দিয়েছিল কৃষাণী।

এসব ভেবে জলে চোখ ভরে আসার কথা রতনের। হলো উল্টো। চোখ দুটো জ্বলে উঠল তার। অফিসারের দিকে তাকিয়ে শীতল গম্ভীর গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না সাহেব। আমাকে হাজতেই রাখুন। ছেড়ে দিলে নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেব আমি।

এই হচ্ছে গল্প।

‘আগামী’ পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, সংকলনে অবিরাম ছাপা হতে লাগল গল্পটি। ’৯৬-৯৭ সালের দিকে বাদল রহমান বললেন, বিটিভির জন্য ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ নাটক হিসেবে তৈরি করবেন।

বাদল রহমান বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনায় ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। জার্মান লেখক এরিখ কাস্টনারের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ তৈরি করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ছোটদের জন্য তৈরি করা প্রথম সার্থক চলচ্চিত্র। সদা হাসিমুখের প্রাণবন্ত মানুষ বাদল ভাই। আমাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দেন, বেশিই ভালোবাসেন। কোনো এক এনজিও বৃক্ষ বিষয়ক একটা ধারাবাহিক তৈরি করবেন ১৩ পর্বের। বাদল ভাইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাদল ভাই আমাকে বললেন লিখে দিতে। সিদ্ধেশ্বরীর ভিকারুননিসা স্কুলের উল্টোদিকে তাঁর ফ্ল্যাট। প্রায়ই যাই সেখানে, সিরিজ নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সিরিজ তৈরি হলো। নাম দিলাম ‘রঙ করা পুতুল’। এই সিরিজ লিখতে গিয়ে বাদল ভাইর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ল। আর সিরিজটি এত সুন্দর, নিখুঁত ভাবে তৈরি করলেন তিনি, আমি তো মুগ্ধই, বিটিভির কর্তাব্যক্তিরা মুগ্ধ, দর্শকরা মুগ্ধ। সুতরাং এই বাদল রহমান যখন ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ তৈরি করতে চাইলেন আমি খুবই ভরসা পেলাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আমার গল্পটি তাহলে যোগ্য লোকের হাতে পড়ল। স্ক্রিপ্ট করলাম। রতন মাঝির চরিত্রে বাদল ভাই নিলেন খালেদ খানকে। কৃষাণীর চরিত্রে তানিয়া আহমেদ। পুবাইলের ওদিককার এক গ্রামে গিয়ে শুটিং করলেন। খালেদ খান হৃদয় উজাড় করে অভিনয় করলেন। তখনকার যিনি তথ্যমন্ত্রী, নাকি তথ্যপ্রতিমন্ত্রী আমার ঠিক মনে নেই, তিনি নাটকটিকে অযথাই একটু কাটাছেঁড়া করলেন। নাটকের মূল সুরটা অনেকখানি নষ্ট করে ফেললেন। কেন যে এটা করলেন, আজও আমি তা বুঝতে পারি না। এক ধরনের মানুষ হাতে ক্ষমতা পেলে অকারণেও কিছু মাতব্বরি করেন, ব্যাপারটা তেমনও হতে পারে।

বাদল ভাই বললেন, কাটাছেঁড়া করা নাটক তিনি চালাবেন না। বিটিভির কর্তাব্যক্তিরা বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে রাজি করালেন। নাটক দেখে আমি খুবই মন খারাপ করলাম। কিন্তু বাদল রহমান দমবার পাত্র নন। তিনি সেই নাটকের আসল প্রিন্ট নিয়ে গেলেন ‘লেজার ভিসন’ নামের এক সিডি কোম্পানির কাছে। যেমন করে হোক এই নাটকের সিডি বের করতে হবে। ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ নামটাও বদলে দিতে বলেছিলেন সেই মন্ত্রী ভদ্রলোক। বাদল ভাই বাধ্য হয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘কোথায় পাবো তারে’। কিন্তু জেদটা তাঁর ভেতর রয়ে গেছে। আসল নামের আসল নাটকটি তিনি দর্শকদেরকে দেখাতে চান। সিডি কোম্পানিকে রাজি করিয়ে সিডি আকারে প্রকাশ করলেন ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’। বাদল রহমানের সেই সময়কার একাগ্রতা দেখে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ভালোবাসা দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। মাঝে মাঝেই তখন বাদল রহমানের অফিসে যাই, নাটকটি নিয়ে তাঁকে যে রকম ভাবতে দেখি, কথা বলতে দেখি, অস্থির হতে দেখি, সবকিছু মিলিয়ে বাদল রহমানকেই একসময় ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পের রতন মাঝি মনে হচ্ছিল আমার।

এই বাদল রহমান মাত্র ৬২ বছর বয়সে আমাদেরকে ছেড়ে গেলেন।

বাদল রহমানের কথা যখনই ভাবী, আমার শুধু মনে হয় আমার গল্পের রতন মাঝি চলে গেছেন। প্রিয় নেতার জন্য রতন মাঝি ওই যে চিড়াটুকু নিয়ে এসেছিলেন ঠিক তেমন শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায় বাদল রহমান রেখে গেলেন তাঁর ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’। তাঁর প্রিয়নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর ভালোবাসার চিহ্ন, শ্রদ্ধার চিহ্ন।

লেখক : স্বনামখ্যাত কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর