সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

এত খাই খাই তাই মাছ-ভাত জীবনও সুখ দেয় নাই

পীর হাবিবুর রহমান

এত খাই খাই তাই মাছ-ভাত জীবনও সুখ দেয় নাই

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আজন্ম মানুষের মোটা ভাত-কাপড়ের জীবন নিশ্চিত করতে লড়াই করেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসে তার নাম অমর হয়ে থাকলেও তার দল এবং রাজনীতির করুণ মৃত্যু ঘটেছে। স্বপ্ন পূরণ হতে দেখেননি।

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নেতারা যা পারেননি সেটি তিনি সাফল্যের সঙ্গে করে ইতিহাসে মহানায়কের আসনে অমরত্ব পেয়েছেন। তিনি তার দীর্ঘ সংগ্রাম লড়াই ও অমিত সাহসের মধ্য দিয়ে সূর্যের মতো প্রচণ্ড তেজ ছড়িয়ে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথে প্রবল ঢেউ তুলেছিলেন। গোটা জাতি যে গভীর বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে ব্যালট বিপ্লবে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তাকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল তিনি তার মর্যাদা রেখেছিলেন ফাঁসির মঞ্চেও আপস না করে, স্বাধীন বাংলার গান গেয়ে। আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তিনিও সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। মানুষের মুখে দুবেলা অন্ন দিয়ে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বিশ্ব মোড়লদের নীল নকশায় এদেশের বিশ্বাসঘাতক একদল খুনি পরিবার-পরিজনসহ তাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নকেই হত্যা করেছিল।

আমাদের গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আজীবন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য লড়াই করেছেন। কৃষকের বন্ধু বাংলার বাঘ-খ্যাত শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও গরিবের ভাগ্যের উন্নতি চেয়েছেন। মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা কুঁড়েঘরের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও আজীবন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি এখন শয্যায় অসুস্থ। তার দলও শেষ। সংগ্রাম করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিংহ থেকে অসংখ্য বামপন্থি রাজনীতিবিদ। অনেকের মৃত্যু হয়েছে। হয়েছে তাদের স্বপ্নের। অনেকের দলেরও মৃত্যু হয়েছে। সমাজতন্ত্র আর প্রতিষ্ঠা হয়নি। সম্ভাবনাও একদম নেই। আজীবন এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে স্বাধীনতা অর্জন করলেও সেই গণতন্ত্র আজও সোনার হরিণ! সামরিক শাসন কবলিত বাংলাদেশে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে দীর্ঘ পোড়খাওয়া সংগ্রামে গণতন্ত্রের লড়াই করেছেন। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। কণ্টকাকীর্ণ পথের সংগ্রামে পায়ে পায়ে তার মৃত্যু হেঁটেছে। তিনি দমেননি।

একই সময়ে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার বন্দুকের উৎসমুখ থেকে জন্ম নেওয়া বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে দলের হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্রের সেই সংগ্রামে তিনিও নেতৃত্ব দিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে। গণতন্ত্রের নবযাত্রায় দুই নেত্রীর নেতৃত্বে মানুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। দেশ সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে এলেও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। মাঝপথে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা রাজনৈতিক সমঝোতার সংস্কৃতিকে কবর দিয়েছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলার রায়ে এখন কারাগারে। বিএনপি এখন কঠিন দুঃসময়ের মুখে।

অন্যদিকে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এখন টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গতিময়তার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর কাছে বিস্ময়কর অবস্থানে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্যের মুকুট মাথায় পরেছেন। উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে তুলে দিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব দেশকে এগিয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় রেকর্ড গড়েছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ডাল-ভাতের নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছিলেন। তার শেষ শাসনামল ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক হত্যাকা  ও বোমা সন্ত্রাসে কলঙ্কিত হয়েছে। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা মাছ-ভাত জীবন দিতে চেয়েছিলেন। সেই জীবন মানুষও পেয়েছে। মওলানা ভাসানী মোটা ভাত কাপড় দিতে না পারলেও শেখ হাসিনা দেশের পোশাকশিল্পের বিপ্লবে এবং কৃষির উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে ভালো ভাত কাপড়ের জীবন দিয়েছেন। কিন্তু গণতন্ত্র এখনো সোনার হরিণ। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আকর্ষণহীনতা ও ভোটাধিকার নিয়ে চারদিকে চলছে হাহাকার রব। সেই গৌরবের রাজনীতির ঐতিহ্য মূল্যবোধ হারিয়ে দেশে রাজদুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। সমাজে শোষণ বৈষম্য বাড়ছে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। একদিকে ব্যাপক জনসংখ্যা অন্যদিকে সীমিত সম্পদ নিয়ে সমস্যা সমাধানের লড়াই চলছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের লড়াইয়ে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবার নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। জনগণ এসবে তার সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন যুগের পর যুগ দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি সমাজে যেখানে সব স্তরে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়েছে সেখানে এ লড়াই কঠিন লড়াই। সুশাসন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও শক্তিশালী স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখা মানুষের অন্তহীন আকুতি। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের জরিপে বাংলাদেশ আজ অসুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে। আগের ১৫৬টি দেশের মধ্যে ১১৫তম আর এবার হয়েছে ১২৫তম। দেশে এত উন্নয়ন তবু কেন দেশ আজ এত অসুখী? সমাজে সেই সাদাকালো যুগের আদর্শিক রাজনীতি নির্বাসিত। নির্বাসিত সামাজিক মূল্যবোধ। একটা অস্থির অশান্ত সময় সবাই যে যেভাবেই পারুক রাতারাতি ক্ষমতাবান না হয় বিত্তবান হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক নৈতিক শক্তি হারিয়ে অর্থ ও ক্ষমতার কাছে দাসত্ব বরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। মানুষে মানুষে পারস্পরিক শ্রদ্ধা মায়া-মমতা আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে লোভ-লালসা সেখানে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। দুর্বলের ওপর সবলের জুলুম অত্যাচার বেড়েই চলেছে। সবার মধ্যেই রাতারাতি বিত্তবৈভ গড়ার লোভ লালসাই তীব্র হয়নি, খাই খাই মনোভাব চরম আকার ধারণ করেছে। আদর্শিক সচ্ছল জীবনযাপনে কারও যেন শান্তি নেই। সমাজের সব ক্ষেত্রেই নির্লজ্জ বেহায়াপনার বেপরোয়া ভাব দেখা দিয়েছে। শান্তি সুখ নির্বাসনে গেছে। হৃদয়ের প্রশান্তির চেয়ে সামাজিক লৌকিকতা ও যেনতেন উপায়ে বিত্তশালী হওয়ার এবং জৌলুস প্রকাশের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে।  মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করা সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ঘরে ঘরে মাদক ছড়িয়ে গেছে। একেকটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাদক সরবরাহ বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থান থেকে সাফল্য কুড়ালেও এর চাহিদা বন্ধে প্রতিটি পরিবার ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে দেখা যাচ্ছে না। কাউন্সিলিং ও মাদকাসক্তের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে গোটা সমাজকে গণজাগরণ ঘটাতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ক্যান্সারের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়া এই ব্যাধি থেকে দেশকে মুক্ত করতে সব মহলকেই প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। চাহিদা যত পূরণ হচ্ছে ততই যেন বাড়ছে। অনেক বাড়িতে এককালে লাইব্রেরি ছিল, বিত্তবৈভব ও দামি আসবাব ছিল না। এখন সেখানে মূল্যবান আসবাব ও মহামূল্যবান অলঙ্কারের সমারোহ ঘটেছে। বই পড়ার আনন্দ নির্বাসিত হয়েছে। সামাজিক আচার-আচরণ মূল্যবোধ ও পারিবারিক অনুশাসন ভেঙে গিয়ে চরম স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা জন্ম নিচ্ছে। যার যত আছে তার তত চাই। এই চাওয়ার কোনো শেষ নেই। সড়ক হত্যাকাে  একের পর এক প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে রাষ্ট্রের ঘুম ভাঙাচ্ছে তারুণ্য। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। পরিবহন সেক্টরে যৌথ মাফিয়াদের কাছে মানুষের জীবন অনিরাপদ হয়ে গেছে। একদিকে ঘুষ-দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠে প্রশাসনকে যেমন আইন কার্যকর করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনই পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও যাত্রী পথচারীদেরও আইন মেনে চলাফেরা করতে হবে। সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি সমাজ খাবার শিক্ষা চিকিৎসা সব খানে ভেজাল আর ফরমালিনের আগ্রাসন। সড়ক শৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়া, মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে পথ হাঁটা রাজধানীর নগরী যানজটে মৃতই নয়, বিষের বাতাসে ভারি। নোংরা ময়লা পরিবেশ দূষণে ও মশার ভয়াবহ উপদ্রবে ঢাকা আজ বসবাসের অনুপযোগী। অস্থির অশান্ত মূল্যবোধহীন লোভের সমাজ এতটাই মানুষকে তাড়িত করছে যে, ব্যক্তিজীবনেও তার প্রভাব পড়ছে। প্রেম ভালোবাসা স্বার্থের কাছে নিয়ত বলি হচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতি, তদবির বাণিজ্যের এই আগ্রাসনের যুগে মানুষের সম্পদ লুটের, দখলের ও আত্মসাৎ করার মতো অপরাধ পরিবার থেকে সমাজে ছড়িয়ে গেছে। মানুষ ঠকানো বিশ্বাসভঙ্গ রীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক লুট হয়, বিদেশে টাকা পাচার হয়, ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াই রাতারাতি ক্ষমতার আনুকূল্যে অনেকের ভাগ্য বদলে যায়। দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়া যায়। লাজলজ্জা দূরে থাক ঘুষ দুর্নীতিতে তদবির বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে বড় হওয়া সামাজিক মর্যাদায় পরিণত হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি বন্ধ করে আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহণই একমাত্র পথ নয়, প্রতিরোধের জন্য কলুষিত সমাজকে মুক্ত করতে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তোলার সময় এসেছে। সেই সাদাকালো সময়ের রাজনীতি ও সমাজই আজ নির্বাসিত হয়নি। ধর্মীয় সম্প্রীতিও বিনষ্ট হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বর্ণবাদের ভয়াবহতার পথ ধরে উঠে এসেছে ধর্মান্ধতার বিষাক্ততা। এখানেও তার ঢেউ লেগেছে। সব মিলিয়ে মানুষের মন থেকে আনন্দ সুখ কেড়ে নিয়েছে নানামুখী অস্থিরতা। গোটা সমাজ আবেগ-অনুভূতিহীন এককথায় বোধহীন হয়ে গেছে। অসহনীয় অনেক কিছুই সইতে সইতে মানুষ ও সমাজ প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। বসন্তের কোকিলের ডাক কারও হৃদয়কে স্পর্শ করে না। ভরা পূর্ণিমার প্লাবিত জোছনা বুকের গহিন থেকে বেদনা জাগিয়ে আনে। সুখের আনন্দে ভাসাতে পারে না। বর্ষা আসে বর্ষা যায় প্রকৃতি যৌবন লাভ করলেও মানুষের চিত্ত প্রফুল্ল হয় না। এই জীবনে আজ তাই চারদিকে খাই খাই, আরও চাই আরও চাই তাই মাছ-ভাত জীবনও মানুষকে সুখ দেয় নাই।

সর্বশেষ খবর