বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

৯ হামলাকারী ৮ জন চিহ্নিত

সবাই উচ্চশিক্ষিত, একজন পড়েছেন ব্রিটেনে

প্রতিদিন ডেস্ক

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় বর্বরতম আত্মঘাতী হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৯-এ দাঁড়িয়েছে। ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের দিন ধারাবাহিক এ বোমা হামলায় অংশ নিয়েছিলেন নয় আত্মঘাতী জঙ্গি। তার মধ্যে ছিলেন একজন নারীও। নয়জনের মধ্যে আটজনকে চিহ্নিত করেছে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ। হামলাকারীরা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের। একজন লেখাপড়া করেছেন ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এসব শিক্ষিত তরুণ কীভাবে জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়লেন তা খুঁজতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তদন্তকারীরা। আর তদন্ত চলাকালেই গতকাল কলম্বোর স্যাভয় নামে একটি জনপ্রিয় সিনেমা হলের সামনে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। অন্যদিকে আত্মঘাতী হামলার আগে গোয়েন্দা সতর্কবার্তা নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা দেশটির পুলিশপ্রধান ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে পদ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, এনডিটিভি, নিউজফার্স্ট শ্রীলঙ্কা।

হামলাকারীরা সবাই শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের : সিরিজ বিস্ফোরণের ঘটনায় নয় আত্মঘাতী হামলাকারী জড়িত ছিলেন বলে নিশ্চিত হয়েছেন দেশটির তদন্তকারীরা। এর মধ্যে আটজনকে শনাক্ত করা গেছে বলে জানিয়েছেন লঙ্কান প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুয়ান বিজয়বর্ধন। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, হামলাকারীরা সবাই শ্রীলঙ্কান। এর মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। ওই দলটির বেশির ভাগই শিক্ষিত এবং তারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের। তারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল এবং তাদের পারিবারিক অবস্থাও ভালো। হামলাকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিভিন্ন দেশে পড়াশোনা করেছেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। একজন ব্রিটেনে লেখাপড়া করেছেন। পরে তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। এরপর শ্রীলঙ্কায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জঙ্গি কর্মকান্ডে  জড়িয়ে পড়াটা চিন্তার বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। হামলাকারীরা আইএসের কর্মকা  থেকে উৎসাহিত হয়ে এবং জঙ্গিদের অর্থায়নে এ হামলা চালিয়েছেন মন্তব্য করে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, এর বেশির ভাগেরই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। কেউ কেউ বিদেশে বসবাস করছিলেন বা সেখানে পড়াশোনা করেছেন। এ সময় তিনি আরও হামলা চালানো হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।

নিহত বেড়ে ৩৫৯, ফের বিস্ফোরণ : কলম্বোয় সিরিজ হামলার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫৯-এ দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে ৩৮ জন বিদেশি রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। এর মধ্যেই গতকাল কলম্বোয় স্যাভয় নামের জনপ্রিয় একটি সিনেমা হলের সামনে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। শ্রীলঙ্কা পুলিশ বিস্ফোরণের তথ্য নিশ্চিত করলেও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

আইএস জঙ্গিদের ছবি প্রকাশ : শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার দায় স্বীকারের পর এবার হামলাকারী দলের সাত জঙ্গি সদস্যের ছবি প্রকাশ করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এএমএকিউ নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে এ ছবি প্রকাশ করেছে তারা। হামলাকারীদের নামের পাশাপাশি তাদের বিবরণও দেওয়া হয়েছে ছবির মাধ্যমে। আইএসের পক্ষে এদের ‘কমান্ডো ভাই’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাত জঙ্গি হলেন আবু উবাইদা, আবু আল মুখতার, আবু খলিল, আবু হামজা, আবু আল বাররা, আবু মুহম্মদ ও আবু আবদুল্লাহ। প্রকাশিত ছবির সঙ্গে হামলাকারী আটজনের ‘কৃতিত্বের’ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে আবু হামজা কলম্বোয় অ্যান্টনি চার্চে মানুষের মাঝখানে গিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেন। আবু খলিল সেন্ট সেবাস্তিয়ান চার্চ গির্জার কাছে গিয়ে ইস্টার উদ্যাপন অনুষ্ঠানের মাঝখানে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটান। আবু মুহম্মদ জিয়েন চার্চের কাছে গিয়ে সবার সঙ্গে নিজেকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। আবু উবাইদা, আবু আল বাররা ও আবু আল মুখতার কলম্বো শহরের মাঝখানে হোটেল সাংগ্রিলা, সিনামুন ও কিংসবারিতে ঢুকে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটান। জঙ্গি সংগঠনের প্রকাশিত এসব তথ্য যাচাই করে দেখার চেষ্টায় রয়েছে কলম্বো। প্রশাসনের সন্দেহের তীর ছিল স্থানীয় মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন এনটিজের দিকে। এ সংগঠনের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিনের যোগ রয়েছে বলে দাবি করেন শ্রীলঙ্কার প্রতিমন্ত্রী রুয়ান বিজয়বর্ধন। হামলার ঘটনায় গতকাল দুপুর পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সতর্কতা গোপন করা হয়েছিল : ২১ এপ্রিল সিরিজ বিস্ফোরণের দুই ঘণ্টা আগেও হামলার ব্যাপারে শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। এর আগে ৪ ও ২০ এপ্রিল রাতেও দুই দফায় লঙ্কান গোয়েন্দাদের এ বিষয়ে সতর্ক করেছিল দিল্লি। ভারত ও শ্রীলঙ্কার সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স। ফরাসি সংবাদমাধ্যম এএফপির হাতে পাওয়া নথি অনুযায়ী, গির্জায় হামলার ব্যাপারে শ্রীলঙ্কার পুলিশকে আগেই সতর্ক করেছিল ‘একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা’। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল পুলিশপ্রধান পুজিথ জয়সুন্দর দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে এ-সংক্রান্ত গোয়েন্দা সতর্কতা পাঠান। এ সতর্কতা নিয়ে কথা বলেছেন শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মুখপাত্র রজিথা সেনারত্ন। তিনি গতকাল বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগেই কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছিল। এতে হামলাকারীদের নামও উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ওই সতর্কতা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে পর্যন্ত পৌঁছেনি।’ এ বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা দেশটির পুলিশপ্রধান ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে পদ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, ‘সুষ্ঠু যোগাযোগ থাকলে শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে সংঘটিত বোমা হামলা প্রতিহত করা সম্ভব ছিল।’ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সতর্কতার তথ্যটি জানা থাকলে গির্জা ও হোটেলে বাড়তি নিরাপত্তা নিতে পারতাম।’

আইজিপিকে গ্রেফতারের দাবি : এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে শ্রীলঙ্কা পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) পুজিথ জয়সুন্দরকে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে। সংসদ সদস্য বিজয়দেশা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্টের কাছে লেখা এক চিঠিতে এ দাবি জানিয়েছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ভয়াবহ নিরাপত্তা হুমকির তথ্য পাওয়ার পরও পুলিশের প্রধান ও ডিফেন্স সেক্রেটারি গুরুত্ব দেননি। তারা উভয়েই প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে সম্ভাব্য ওই হামলার ব্যাপারে অবগত করেননি। এমনকি এ ধরনের হুমকি মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশও দেননি পুলিশপ্রধান।

বাগদাদির প্রতি আনুগত্য হামলাকারীর : আইএসের কথিত মুখপত্র ‘আমাক নিউজ এজেন্সি’ থেকে প্রকাশিত এক ভিডিওতে সংগঠনের শীর্ষ নেতা আবু বকর আল বাগদাদির প্রতি আট ব্যক্তিকে আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তাদের ন্যাশনাল তাওহিদ জামাতের সদস্য উল্লেখ করে ওই জঙ্গিগোষ্ঠী দাবি করেছে, শ্রীলঙ্কার চার্চ ও হোটেলের আত্মঘাতী হামলায় জড়িত ছিলেন তারা।

শ্রীলঙ্কায় বোরকা নিষিদ্ধের দাবি : শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে বিতর্কে দেশটির একজন এমপি বোরকা, হিজাব ও মুখ ঢেকে রাখা যায় এমন যে কোনো ধর্মীয় রীতি মেনে তৈরি পোশাক নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব তুলেছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সেই এমপির বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। শ্রীলঙ্কান সেই এমপি সিএনএনকে জানান, তিনি বিশ্বাস করেন মুখ ঢেখে রাখার ব্যাপারটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ। আর এর কারণে কাউকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, শ্রীলঙ্কার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মুখ ঢেকে রাখার ব্যাপারটা ঐতিহ্যগত নয়। তবে পার্লামেন্টে ওই এমপির প্রস্তাবটি নিয়ে কবে আলোচনা হবে তার কোনো তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি।

নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর অঙ্গীকার : ভয়াবহ সিরিজ বিস্ফোরণের পর শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর অঙ্গীকার করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। মঙ্গলবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে তিনি এমন অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শ্রীলঙ্কার পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হবে। মাইথ্রিপালা সিরিসেনা বলেন, যেসব নিরাপত্তা কর্মকর্তা হামলার ব্যাপারে আগেই গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলেন, তারা এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেননি। ওইসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সমুদ্রে ভারতের কড়া নজরদারি : শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় জড়িত ব্যক্তিরা যাতে সমুদ্রপথে সে দেশ থেকে পালাতে না পারেন, এজন্য ভারতের কোস্টগার্ড সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে থাকা সমুদ্রসীমায় ভারতীয় কোস্টগার্ডকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। হামলাকারীরা যাতে শ্রীলঙ্কা থেকে সমুদ্রপথে পালিয়ে ভারতে ঢুকতে না পারেন, সেজন্যই তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। সমুদ্রে কড়া টহলদারির কাজে ভারত একাধিক জাহাজ ও উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর