সুবীর নন্দী আর গাইবেন না। তার কণ্ঠ থেকে আর বের হবে না সুর। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’ কালজয়ী গানগুলোও এখন থেকে ইতিহাস হয়ে যাবে। অগণিত ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তি গায়ক একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী সুবীর নন্দী। গতকাল বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৪টায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন তার মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী। দীর্ঘদিন যাবৎ হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন সুবীর নন্দী। তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। তিনি স্ত্রী পূরবী নন্দী, মেয়ে ফাল্গুনী নন্দীসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, সুহৃদ ও শুভাকাক্সক্ষী রেখে গেছেন। সুবীর নন্দীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাকের পার্টির চেয়ারম্যান পীরজাদা মোস্তফা আমীর ফয়সাল প্রমুখ। আজ বুধবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে সুবীর নন্দীর লাশ ঢাকায় এসে পৌঁছবে। বিমানবন্দর থেকে লাশ নেওয়া হবে ২৫সি গ্রিন রোডের গ্রিন ভিউ অ্যাপার্টমেন্টে। সেখান থেকে বেলা ১১টায় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সুবীর নন্দীর লাশ নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এরপর নেওয়া হবে রামকৃষ্ণ মিশনে। দুপুরে সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালী মন্দির ও শ্মশানে তার শেষকৃত্য হবে।
১৪ এপ্রিল হার্ট অ্যাটাক করার পর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে ছিলেন সুবীর নন্দী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ৩০ এপ্রিল তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী ৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র মিলিয়ে আড়াই হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি শুধু সংগীতশিল্পী নন, অসংখ্য গানের গীতিকার ও সুরকারও। ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন সুবীর নন্দী। ১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই গান গাওয়া শুরু করেন সুবীর নন্দী। ’৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। ঢাকা বেতারে সুযোগ পান ’৭০ সালে। সে সময় তিনি নজরুলগীতি গেয়ে রেডিওর অডিশনে পাস করেন। ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারসহ আগরতলায় চলে যান। সুবীর নন্দীর প্রথম রেকর্ড করা গান ‘যদি কেউ ধুপ জ্বেলে দেয়’। এটি রেকর্ড করা হয় ’৭২ সালে। একই বছর তিনি জনতা ব্যাংকে চাকরি নেন এবং ২০১০ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকেই কর্মরত ছিলেন। চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যক করেন ’৭৪ সালে আবদুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ ছবিতে। ’৮১ সালে পূরবী নন্দীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সুবীর নন্দী। তাদের একমাত্র সন্তান ফাল্পুনী নন্দী। একই বছর তার একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। এখন পর্যন্ত ২৮টি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে সুবীর নন্দীর। তার উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গানগুলো হচ্ছে- ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাব’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’ ইত্যাদি।