সাগর পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাওয়া হলো না তাদের। তীরে তরী বেড়ার আগেই সাগরের নীল জলে লীন হয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন। ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি ঘটেছে ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া প্রায় ৬০ জন অভিবাসীর। এর মধ্যে সিলেটেরও অনেক যাত্রী রয়েছেন। সাগরে ডুবে মারা যাওয়া সিলেটের ৭ যুবকের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা সিলেটের এক দালালের মাধ্যমে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেছিলেন।
ট্রলারডুবিতে প্রাণহানির ঘটনার পর থেকে সিলেট নগরীর রাজাম্যানশনের ‘নিউ ইয়াহিয়া ওভারসিজ’-এর মালিক ওই দালাল তার অফিসে তালা দিয়ে পালিয়েছেন। এদিকে সাগর থেকে তিউনেসিয়ার জেলেরা যে ১৬ জনকে উদ্ধার করেছে তাদের মধ্যেও সিলেটের কয়েকজন রয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত ট্রলার ডুবে মারা যাওয়া সিলেটের যাদের পরিচয় জানা গেছে তারা হলেন- ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার সেনেরবাজার কটালপুর এলাকার মুহিদপুর গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে আহমদ হোসেন, একই গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে আবদুল আজিজ, সিরাজ মিয়ার ছেলে লিটন মিয়া, একই উপজেলার ভেলকোনা গ্রামের ব্রাজিল প্রবাসী তাজ উদ্দিনের ছোট ভাই আয়াজ উদ্দিন, গোলাপগঞ্জের হাওরতলা গ্রামের মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে আফজাল মোহাম্মদ, গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কদুপুর গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে কামরান আহমদ মারুফ ও মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমাইল গ্রামের হাফিজ আহসান হাবীব শামীম। এর মধ্যে হাফিজ আহসান হাবীব শামীম সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই ও কামরান আহমদ মারুফ তার শ্যালক। এদিকে উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে একজন হচ্ছেন কামরান আহমদ মারুফের বড় ভাই মাছুম আহমদ। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও নিজের চোখের সামনে তিনি ডুবে যেতে দেখেছেন ছোট ভাই মারুফ ও তালতো ভাই শামীমকে। গতকাল পর্যন্ত ট্রলার ডুবে মারা যাওয়া ৭ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেলেও এখনো সিলেটের অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ মিলেছে দুজনের : সিলেটের নিখোঁজ যুবকদের মধ্যে দুজনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তারা হলেন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মহিদপুর মাঝপাড়া গ্রামের মৃত তজমুল আলীর ছেলে বিলাল আহমদ ও একই উপজেলার দিনপুর গ্রামের ছানু মিয়ার ছেলে শিজুর মিয়া। ট্রলারডুবির পর তিউনিসিয়ার জেলেরা তাদের উদ্ধার করে। বর্তমানে তারা সেখানকার একটি আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন। মোবাইল ফোনে তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চুক্তি ছিল ৮ লাখ টাকার : ট্রলার ডুবে মারা যাওয়া অভিবাসীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে তারা দালালের সঙ্গে ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেছিলেন। এর মধ্যে কেউ কেউ কয়েক কিস্তিতে ৬ লাখ টাকা, আবার কেউ পুরো টাকাই পরিশোধ করেছেন। যাদের টাকা বাকি ছিল তারা ইতালি পৌঁছার পর দেওয়ার কথা ছিল। চুক্তির সময় দালাল নিরাপদে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর থেকে দালাল যাত্রীদের থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন ব্যাপারে চুক্তি ভঙ্গ করে অমানবিক আচরণ করছিলেন। যাত্রীদের জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হতো, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে দালালের বিরুদ্ধে। ইতালিতে পৌঁছে গেলেই মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করা যাবে- এমন প্রলোভন দেখিয়েই মূলত বিদেশগামী যুবকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল দালাল, জানিয়েছেন শোকাহত পরিবারের সদস্যরা।
চার দেশ ঘুরেও যাওয়া হলো না ইতালি : ইতালি পাঠানোর জন্য আট লাখ টাকার চুক্তি করে সিলেটের রাজাম্যানশনের ‘নিউ ইয়াহিয়া ওভারসিজ’-এর মালিক মোহাম্মদ এনামুল হক। এরপর সিলেটের যাত্রীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে। সেখানে কিছু দিন রেখে দালালের মাধ্যমে তাদের পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কায়। এরপর তাদের গন্তব্য হয় লিবিয়ায়। লিবিয়া থেকে একটি বড় ট্রলারে করে তাদের পাঠানো হয় তিউনেসিয়ায়। তিউনেসিয়ার উপকূলে তাদের নামিয়ে দিয়ে তোলা হয় ছোট্ট ট্রলারে। ট্রলারটি প্রায় ১০ মিনিট চলার পরই ডুবে যায়। সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় সিলেটের ৬ যুবকের ইতালি যাত্রার স্বপ্ন। প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে লিবিয়ার উপকূল থেকে ৭৫ জন অভিবাসী একটি বড় নৌকায় করে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হন। গভীর সাগরে তাদের বড় নৌকাটি থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি নৌকায় তোলা হলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটি ডুবে যায়। তিউনেসিয়ার জেলেরা ১৬ জনকে উদ্ধার করে গত শনিবার সকালে জারযিজ শহরের তীরে নিয়ে আসে। উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা জানান, সাগরের পানিতে তারা প্রায় আট ঘণ্টা ভেসে ছিলেন। উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের ১৪ জনই বাংলাদেশি।