বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

মিন্নির রিমান্ড নিয়ে তোলপাড়

মূল আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, আদালতে পুলিশের সাফাই, মিন্নি বললেন ষড়যন্ত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও বরগুনা প্রতিনিধি

মিন্নির রিমান্ড নিয়ে তোলপাড়

বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ১ নম্বর সাক্ষী নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। আদালতে মিন্নি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। অন্যদিকে তার বাবা সাংবাদিকদের বলেছেন, পুলিশ রহস্যজনক কারণে তার মেয়েকে আটক করেছে। নারী নেত্রীরা বলছেন, প্রধান সাক্ষীকে আটক মূল ঘটনা আড়াল ও আলোচনা ভিন্ন দিকে প্রবাহের চেষ্টা কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।

এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পৃক্ততা আছে দাবি করে গতকাল আদালতকে বলেন, রিফাতকে বাঁচানোর জন্য মিন্নির যে ভূমিকা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, তা ছিল নাটক মাত্র। আসামিদের সঙ্গে মিন্নির যোগাযোগ ছিল। এ সময় মিন্নির পক্ষের কোনো আইনজীবী আদালতে ছিলেন না। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মিন্নি নিজেই বক্তব্য দিতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নির্দোষ। আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন সময় আসামিরা আমাকে ফোনে বিরক্ত করত ও ভয়ভীতি এবং প্রাণনাশের হুমকি দিত। আমি বা আমার পরিবার আসামিদের ভয়ে কোথাও মুখ খুলতে পারিনি। আমি খুনিদের বিচার চাই।’ আদালত শুনানি শেষে রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিফাত শরীফকে হত্যায় সরাসরি জড়িতদের বাইরে রেখে মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী মিন্নিকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেওয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, মূল আসামিদের রক্ষা এবং মামলার মোড় ভিন্ন দিকে ঘোরাতেই পুলিশ মিন্নিকে গ্রেফতার করেছে। এ অবস্থায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। হত্যাকান্ডে জড়িত সব আসামিকে পুলিশ এখনো গ্রেফতার করেনি। অথচ আলোচিত এই মামলার প্রধান সাক্ষীকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে। এর আগে পুলিশ মিন্নির জবানবন্দিও রেকর্ড করেছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবার সেই জবানবন্দি রেকর্ডের কথা বলে তাদের বাড়ি থেকে মিন্নি ও তার বাবাকে নিয়ে যায় জেলা পুুলিশ লাইনসে। সেখানে নিয়েই মিন্নিকে আলাদা করা হয়। দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ৯টায় মিন্নিকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করতে হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত আমরা সব সময়ই প্রত্যাশা করি। কিন্তু কাউকে ভিকটিম বানিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের যেন আড়াল করা না হয়। আমাদের দেশে মেয়েদের চরিত্র নিয়ে খুব সহজেই প্রশ্ন তোলা হয়। পরিস্থিতি ঘোলাটে করে কেউ ফায়দা লুটছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’ অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১ নম্বর সাক্ষীকে আসামি হিসেবে গ্রেফতার করায় মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল। মূল আসামিরাও এ মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ পাবে। এদিকে মিন্নিকে রিমান্ডে নেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বরগুনায় বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে এ ঘটনাকে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বলেই মনে করছেন। তারা বলছেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করা হচ্ছে।

পাঁচ দিনের রিমান্ড : বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ১ নম্বর সাক্ষী নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল বরগুনার বিচারিক হাকিম মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী এ আদেশ দেন। দুপুরে মিন্নিকে কড়া পুলিশ প্রহরায় আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির মিন্নিকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। আদালত পাঁচ দিন মঞ্জুর করে। জানা গেছে, বিকাল ৩টা ১০ মিনিটে পুলিশ মিন্নিকে বরগুনার বিচারিক আদালতে হাজির করে। এ সময় আদালতের চারপাশে কড়া পুলিশ প্রহরা ছিল। আদালতের বাইরে মিন্নির বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনরা উপস্থিত থাকলেও কারও সঙ্গে তাকে কথা বলেত দেওয়া হয়নি। আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর পৌনে ৪টার দিকে মিন্নিকে আদালত থেকে বের করে কড়া প্রহরায় পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়। গত মঙ্গলবার মিন্নিকে প্রায় ১৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ এ মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়। বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন।

মিন্নির বাবার আবেদন : রিমান্ডের পর মিন্নির বাবা অভিযোগ করেন, মিন্নিকে গ্রেফতারের বিষয়টি ষড়যন্ত্র। মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত এবং এই খুনের সঙ্গে জড়িতদের আড়াল করার জন্যই এগুলো সাজানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই খুনের নেপথ্যে যারা আছেন তারা খুবই ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী। তাদের কাছে দুনিয়ার সবই হার মেনে যাবে। আমরা খুবই সাধারণ মানুষ, তাদের কাছে খুবই সামান্য। আমরা তাদের হাতে যে কোনো সময় শেষ হয়ে যেতে পারি। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি, আমাদের এ ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচান।’ তিনি সঠিক তদন্ত করে যারা প্রকৃত দোষী, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। মিন্নির বাবা বলেন, ‘মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ এসে আসামি শনাক্ত করার জন্য মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে নিয়ে যায়। আমি সঙ্গে যাই। এরপর আমাকে নাশতা খেতে দিয়ে বাইরে বসিয়ে রেখে মেয়েকে পুলিশ লাইনসের ভিতরে নিয়ে যায় পুলিশ। আমি রাত ১০টা পর্যন্ত মেয়ের জন্য বাইরে অপেক্ষা করি। এরপর আমাকে জানানো হয়, মিন্নিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কী জন্য আমার মেয়েকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আমার মেয়ে এ মামলার ১ নম্বর সাক্ষী। প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত শরীফকে যখন সন্ত্রাসীরা কোপাচ্ছিল, তখন আমার মেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। সে নিজের জীবনের দিকে তাকায়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা কীসের বলি হলাম? স্বামীকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে খুন করার পর থেকে আমার মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’ অন্যদিকে রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বলেন, ‘মিন্নিকে গ্রেফতার করায় আমি খুশি। কারণ, আমি এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি করেছিলাম। আর মিন্নিকে গ্রেফতার করা হয়েছে সম্পূর্ণ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েই এটা করেছে। এটা প্রশাসনের ব্যাপার।’ মিন্নির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে কোনো মহল প্রভাবিত করেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য নয়।’

অন্যতম পাঁচজন অধরা : গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের পরদিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার মধ্যে ১০ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজীসহ তিন আসামি এখনো রিমান্ডে আছেন। তবে এ মামলার অন্যতম আসামি রিশান ফরাজীসহ বাকি পাঁচ আসামি এখনো গ্রেফতার হননি।

মিন্নি মুখ খোলার পরই গ্রেফতার : রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের ১৭ দিন পর ১৩ জুলাই রাতে রিফাতের বাবা বরগুনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে মিন্নির গ্রেফতর দাবি করেন। রিফাতের বাবার অভিযোগের ফলে আলোচিত এ হত্যা মামলা নাটকীয় মোড় নেয়। পরদিন ১৪ জুলাই মিন্নির গ্রেফতার দাবিতে বরগুনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন হয়। ওই মানববন্ধনে রিফাতের বাবা ছাড়াও বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলে সুনাম দেবনাথ বক্তব্য দেন। ১৪ জুলাইর এ মানববন্ধনের পর দুপুরে মিন্নি তার বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, যারা বরগুনায় ‘বন্ড ০০৭’ নামে সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করিয়েছিলেন, তারা খুবই ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী। এই ক্ষমতাবানেরা বিচারের আওতা থেকে দূরে থাকা এবং এই হত্যা মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহের জন্য তার শ্বশুরকে চাপ দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছেন। এরপর ১৬ জুলাই মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করা হয়।

মিন্নির গ্রেফতার নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে ক্ষোভ : বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের সাক্ষী রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতারের পেছনে প্রভাবশালী কারও প্ররোচনা রয়েছে কি না, তা জানতে চেয়েছে সংসদীয় কমিটি। একই সঙ্গে কুমিল্লার জজ আদালতে বিচারকের খাসকামরায় এক আসামির ছুরিকাঘাতে আরেক আসামি নিহত হওয়ার ঘটনায় আদালতের নিরাপত্তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা।

সংসদ ভবনে গতকাল অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয়ে এমপিরা প্রশ্ন ও ক্ষোভ প্রকাশ করায় এজেন্ডা ছাড়াই বিষয় দুটি পর্যালোনা করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মো. আফছারুল আমীন, মো. হাবিবুর রহমান, সামছুল আলম দুদু, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ বৈঠকে অংশ নেন।

কমিটি সূত্র জানায়, বৈঠকে মিন্নির বিষয়টি উত্থাপন করেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘটনার তদন্ত শেষ না হলে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু বলেন, ‘আমরা বিষয়টা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। দেখতে হবে কার দুর্বলতা আছে।’ তিনি বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে এ ধরনের ঘটনা আর অন্য কোথাও হত্যার ঘটনা এক নয়। জাতির জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমরা সুষ্ঠু তদন্ত করতে বলেছি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনার ‘বেটার’ তদন্ত চলছে। দোষী যে-ই হোক তাকে আইনের মুখোমুখি করা হবে।’ বৈঠক শেষে পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বরগুনার ওই হত্যাকা- একটি আলোচিত ঘটনা। কিন্তু হঠাৎ করে মিন্নিকে গ্রেফতার করায় বিভিন্ন আলোচনা উঠেছে। আমি বৈঠকে বলেছি, মিন্নিকে কারও প্ররোচনায় গ্রেফতার করা হয়েছে কি না সেই আলোচনাও বিভিন্ন মহলে উঠেছে। এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য জানতে চেয়েছি আমি। তবে পুলিশ কোনো উত্তর দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্য শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে উপসংহার টানার সময় এখনো আসেনি।’

সর্বশেষ খবর