শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

কুঁড়েঘরের সেই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

কুঁড়েঘরের সেই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই

চলে গেলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি ও উপমহাদেশে বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ৪৯ মিনিটে রাজধানীর এ্যাপোলো  হসপিটালসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তিনি স্ত্রী আমিনা আহমদ এবং একমাত্র মেয়ে আইভী আহমদসহ অসংখ্য ভক্ত, গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিন বছর ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় বারিধারায় মেয়ের বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১৪ আগস্ট হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। ১৯ আগস্ট আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সংগঠন শোক জানিয়েছে। তার মরদেহ এ্যাপোলো হসপিটালসের হিমঘরে রাখা হয়েছে। আজ বেলা ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম জানাজা, সাড়ে ১১টায় নিউ মার্কেট পার্টি অফিসের সামনে দ্বিতীয় জানাজা, দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের নাগরিকদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তৃতীয় জানাজা শেষে কুমিল্লার দেবিদ্বারের এলাহাবাদে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে আগামীকাল সর্বশেষ জানাজা শেষে বাদ জোহর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুর খবর শুনে গত রাতে তার দলের নেতা-কর্মী, আত্মীয়স্বজন ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হাসপাতালে ছুটে যান। রাজধানীর বারিধারায় মেয়ের বাসায় স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে থাকতেন তিনি। সেখানে একটি রুমে চিকিৎসার বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে হাসপাতালের মতো করেই চিকিৎসা চলত তার। ২০১৫ সালে তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও রাজনৈতিক আদর্শের কারণে তিনি সবিনয়ে তা গ্রহণে অপারগতা জানান। নির্লোভ ও নীতি-নিষ্ঠার প্রতীক ছিলেন তিনি।

‘কুঁড়েঘর’ মার্কার মোজাফফর নামে খ্যাত ন্যাপপ্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। প্রায় আট দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মোজাফফর আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক জীবন বেছে নিয়েছিলেন। দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ মোজাফফর আহমদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মোজাফফর আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৩৭ সালে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি ও তার স্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৫৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কুমিল্লার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করেন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপনে থেকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। আট বছর আত্মগোপনে থেকে ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন ছিলেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ওই সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি আবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ, সিপিবি ও প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে কারারুদ্ধ হন।

শোক : অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলমসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর