মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা
নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি হবে না দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলবে

আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে

রুহুল আমিন রাসেল, নিউইয়র্ক থেকে

ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি হবে না দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলবে

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -আবু তাহের খোকন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে এবং জনগণ উন্নয়নের সুফল পায়, সে কারণেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। কোনো অপরাধীই ছাড় পাবে না। এটা বলাই যায় যে, ওয়ান-ইলেভেন পুনরায় ঘটবে না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় রবিবার বিকালে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় মঞ্চে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন। সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নিজ হাতে নথিপত্র তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অনেকেই অখুশি, কিন্তু কিছু করার নেই। দুর্নীতি করে কোনো অপরাধীই ছাড় পাবে না। এমনকি দলীয় লোক হলেও ছাড় পাবে না। দেশে আর যেন ওয়ান-ইলেভেন না হয়, সে কারণেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। আমরা সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করছি। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল নিশ্চিত করাটাও এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের লক্ষ্য।’ তিনি বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির আগেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তাঁর সরকার, যাতে এ ধরনের ঘটনা পুনরায় না ঘটতে পারে। এটা বলাই যায় (স্পষ্টত) যে, ওয়ান-ইলেভেন পুনরায় ঘটবে না। যদি কোনো অনিয়ম থেকে থাকে, আমরা ব্যবস্থা নেব এবং সে যেই হোক না কেন। যদি আমি দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে চাই, আমার ঘর থেকেই তা আগে শুরু করতে হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রকল্প প্রস্তুতি থেকে শুরু করে প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য অর্থ বিতরণের সুযোগ নিয়ে কিছু লোক বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছে। এই অর্থ চটের বস্তায়ও লুকিয়ে রাখা হচ্ছে এবং ওয়ান-ইলেভেনের পট পরিবর্তনের পর আমরা এটা দেখেছি।’ তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে যে সম্পদ আসে তা দেখানো কিছু মানুষের স্বভাব। আমাদের সমাজের এ অংশটিকে আঘাত করতে হবে।’ জনগণের জন্যই তাঁর রাজনীতি এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় এসেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় জনগণের মঙ্গলের কথাই চিন্তা করি।’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আমার দল এবং সমাজের ওপর ক্ষতিকারক কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা সে বিষয়েও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমাকে সেটা মোকাবিলাও করতে হবে। যে কারণে আমি এ অভিযান চালাচ্ছি। কিছু লোক এ অভিযান পরিচালনায় আমার ওপর অখুশি। কিন্তু আমি এর পরোয়া করি না। কেননা ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতি আমার কোনো মোহ নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে এবং চলবে। এজন্য কোনো বিশেষ কমিটি গঠনের প্রয়োজন নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমি চাই, দেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত ও সুন্দর জীবনযাপন করবে। এ সুযোগে কিছুসংখ্যক মানুষ সমাজকে বিষাক্ত করবে, তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে আমি এই নির্দেশ দিয়েছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে খেলাধুলার উন্নয়নে ক্রীড়াসামগ্রীর আমদানি খুবই ভালো। কিন্তু এটা অকল্পনীয় যে, ক্রীড়াসামগ্রী আমদানির নামে জুয়ার জিনিসপত্র আনা হবে। দেশে যে কোনো ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির তৎপরতা প্রতিরোধে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং আমরা এ অভিযানে প্রায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে। এখন আমরা দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছি। সরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এ লক্ষ্যে বহু প্রকল্প তৈরি ও এসব প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হবে এবং এসব কাজও সম্পন্ন হবে নির্বিঘ্নে। এতে কোনো অনিয়ম হলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এর ফলে আমরা যেভাবে দেশের উন্নয়নের চিন্তা করছি, তা সম্পন্ন হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও তাদের সরকারের ওপর আস্থা রাখতে না পারা দেশটির জন্য লজ্জাজনক। মিয়ানমারকেই এ সংকটের সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমার এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরই এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। তারা যে কথাই বলুক না কেন, মিয়ানমারই এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরই এর সমাধান দিতে হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে যোগদানকারী মিয়ানমার নেতার বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলতে বাংলাদেশের দাবিকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের নাগরিক অন্য দেশের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে, এটা হচ্ছে মিয়ানমারের জন্য লজ্জা, অসম্মান এবং একই সঙ্গে তাদের দুর্বলতা। এটা আমাদের কাছে খুব বড় প্রশ্ন যে, কেন তারা তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে না?’ শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ বিষয়ে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও সৃষ্টি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে মিয়ানমারের আস্থা সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা বাসভূমিতে ফিরে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি জাতিসংঘ মহাসচিবের মধ্যাহ্নভোজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছি।’ চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সরকার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী জাতির পিতার খুনিদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে। মূলত এ বিষয়ে তাকে (ট্রাম্প) চিঠি দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় খুবই সোচ্চার। তাহলে কী করে এই দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) জাতির পিতা, নারী ও শিশু হত্যাকারীরা থাকতে পারে? তিনি বলেন, ‘একজন খুনি কানাডায় রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করছে। আমরা সবাইকে খুনিদের ফেরত পাঠাতে অনুরোধ করেছি। এই খুনিরা ওইসব দেশের জন্যও নিরাপদ নয়।’ খেলাপি ঋণ ও শেয়ারবাজারে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান দেশে ঋণখেলাপি চর্চা শুরু করেছিলেন। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর জিয়াউর রহমান বলেছিলেন যে, অর্থ কোনো সমস্যা নয় এবং তিনি ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। এ সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ব্যাংকের অধিক সুদের কারণে অনেকের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ফলে তারা ঋণখেলাপি হয়। তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, ঋণ পরিশোধ করার প্রয়োজন নেই। অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। কিন্তু তারা ঋণ পরিশোধ করছে না। সম্প্রতি আপনারা দেখেছেন যে গ্রামীণফোন কী করছে। তারা কর পরিশোধ করে না এবং যখন করের পরিমাণ বিপুল হয়ে দাঁড়ায়, তখন তারা বলে যে আসুন আলোচনা করি। আপনি একবার বা দুবার তা করতে পারেন। কিন্তু বার বার করতে পারেন না।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আরেকটি সমস্যা রয়েছে, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার সময় অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়েছেন। কারণ, তারা সে সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন বা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তাদের একটা সুযোগ দিয়েছিলাম যাতে তারা তাদের শিল্পকারখানা চালাতে পারেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘিœত না হয় যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করেন।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং যাতে ঋণখেলাপি সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে সরকার বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আমরা ইতিমধ্যে ব্যাংকের সুদহার এককের ঘরে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি এবং রাষ্ট্রচালিত ব্যাংকগুলো এ নির্দেশ অনুসরণ করছে।’ শেয়ারবাজার সম্পর্কে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘এতে যারা সম্পৃক্ত রয়েছেন তাদের অবশ্যই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে কোন শেয়ার লাভজনক, আর কোনগুলো নয়। এসব বিবেচনা করেই তাদের শেয়ার কিনতে হবে। সরকার শেয়ারবাজারের ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেকবার শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। তারপর বাজার আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’ লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে তাঁর অংশগ্রহণ, পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রযুত চান-ও-চাসহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর