হোলি আর্টিজান বেকারিতে বর্বরোচিত হামলা মামলার রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাত জঙ্গির কারও কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি। বরং তাদের আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ। আদালত কক্ষ থেকে বের করার সময় তারা স্লোগান দিতে থাকে। আসামি রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের পতাকার প্রতীক সংবলিত টুপি পরেই আদালত থেকে বের হন। প্রিজন ভ্যানে তোলার পর জাহাঙ্গীর আলম নামে আরও এক জঙ্গিকেও একই রকম টুপি পরে থাকতে দেখা যায়। কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আনা এসব জঙ্গি আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি কোথায় পেলেন তা নিয়ে উপস্থিত সবার মধ্যে বিস্ময় ও প্রশ্ন তৈরি হয়। প্রশ্ন উঠেছে আসামিদের আনা-নেওয়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। আইএসের প্রতীক সংবলিত এই টুপি কী করে জঙ্গিদের হাতে এলো, তা তদন্তের দাবি উঠেছে সব মহলে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আসামিদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ ইস্যুতে আবারও প্রশ্ন উঠবে আন্তর্জাতিক মহলে। আসামিরা কি কারাগার থেকে আসার সময়ই এই টুপি নিয়ে এসেছেন, নাকি এজলাসেই কেউ সরবরাহ করেছেন, বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এদিকে, আইএসের টুপির বিষয়টি তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে আদালতে আনার সময় কারও মাথায় এমন টুপি ছিল না। বের হওয়ার সময় রাকিবুলের মাথায় এই টুপি দেখা যায়। আসামিদের নিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের লিফটে নেমে যাওয়ার সময় কেউ কেউ এই টুপি খুলে ফেলতে বার বার বললেও তাতে কান দেয়নি পুলিশ। এরা কারাগার থেকে এ টুপি নিয়ে এসেছেন নাকি আদালতে আনার সময় বা আনার পর কোনোভাবে তাদের কাছে এই টুপি এসেছে, এ নিয়েও আদালত চত্বরে আলোচনা চলছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দন্ডপ্রাপ্ত নব্য জেএমবির এসব জঙ্গি আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানের ভিতর থেকে চিৎকার করে নিজেদের কর্মকান্ডের পক্ষে বলতে থাকেন। একই সঙ্গে স্লোগান দিতে থাকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসামিরা জামিনে ছিল না, তারা কারাগারে ছিল, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তারা এই টুপি পেল কোথায়। কারাগার থেকে যখন আসামিদের আদালতে আনা হলো, তখন তো তাদের তল্লাশি করে আনার কথা। এই টুপি ইস্যুতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কারা কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে পুলিশ বা কারা কর্তৃপক্ষের কেউ জড়িত কিনা, এ বিষয়টি তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও তার মত। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রকাশ্যে আইএসের টুপি মাথায় পরার বিষয়টিকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সারোয়ার খান জাকির সাংবাদিকদের বলেন, এজলাসে আসামিদের মাথায় এই টুপি ছিল না, তবে পরে কোথা থেকে এলো, এটা তদন্ত করে দেখা দরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাধারণত ভয়ঙ্কর অপরাধী বা গুরুত্বপূর্ণ অপরাধীদের কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার সময়, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরানো হয়। তবে হোলি আর্টিজান মামলার রায় ঘোষণার দিনও ভয়ঙ্কর এসব আসামিকে পরানো হয়নি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বা হেলমেট। হেলমেট না পরানোয়ই আসামিরা আইএসের টুপি পরার সুযোগ পেয়েছে বলে দাবি সূত্রের। রায় ঘোষণার পর আসামিদের প্রকাশ্যে আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি পরার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছেও। প্রশ্নের জবাবে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিষয়টি জেনেছি, এটি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। আমি এখনই তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, এটি আমরা দেখেছি, ছবিও দেখেছি। আমরা বিস্মিত হয়েছি। কারাগার থেকে আনার সময় আসামিদের তল্লাশি করে দেখা হয়, তাদের সঙ্গে কী আছে তা দেখা হয়। এ ধরনের টুপি তাদের কাছে কীভাবে গেল, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হবে।
কারা কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি গঠন : রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাত আসামির মধ্যে দুজনের মাথায় আইএসের প্রতীক সংবলিত কালো টুপির বিষয়ে তদন্ত করবে কারা কর্তৃপক্ষ। এজন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি, প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা।
গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আসামিদের মাথায় আইএসের টুপির বিষয়টি গণমাধ্যমে দেখেছি। এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। দেশের সব কারাগারে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।