মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাদারিত্ব

আমলাতন্ত্রের দাপটে যত হতাশা

অনেক সচিবই গুরুত্ব দেন না মন্ত্রীদের, মাঠ প্রশাসনেও জনপ্রতিনিধিরা উপেক্ষিত অনেক কর্মকর্তা সরাসরি যোগ দেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ে আমলাতন্ত্রের দাপটে প্রশাসনে চরম হতাশা তৈরি হয়েছে। অনেক সচিবই মন্ত্রীদের গুরুত্ব দেন না। সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের মতো করে। এতে উপেক্ষিত মন্ত্রী দুঃখ করেন রাজনৈতিক মহলে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মতো মাঠ পর্যায়েও কর্মরত অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করেন না। কেউ কেউ অতি উৎসাহ নিয়ে যোগ দেন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে। অনেক কর্মকর্তাই নিজের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে ব্যস্ত। তারা বর্তমান পরিচয় দিতে চান না। তারা আচরণে, কার্যক্রমে চলেন রাজনীতিবিদদের মতো করে। আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন করার কারণে মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়ররা অনেক সময় নিজের কর্মীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে এর ডালপালা আরও ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। এতে সরকারের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। সাবেক আমলা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের আজকের এ অবস্থার জন্য রাজনৈতিক নেতারাই অনেকাংশে দায়ী। আমলাদের এমন দাপুটে অবস্থার কারণে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু আমলাতন্ত্রেই যে এই অবস্থা তা নয়, সাবেক আমলারা মনে করেন, পুলিশ প্রশাসনেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।

মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, রাজনৈতিক নেতারাই প্রশাসনযন্ত্রকে রাজনীতিকরণ করতে গিয়ে আজকের এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা পেশাদারিত্বের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজনৈতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দিলে এমনটা হতে থাকবে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে।

তিনি বলেন, শুধু সচিবরাই নয়, ক্ষমতার দাপট দেখান অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব, উপ-সচিবরাও। যাদের ক্ষমতা যত বেশি তারা ততটাই দেখান। মন্ত্রিপরিষদের সাবেক এই সচিব বলেন, শুধু প্রশাসন বা আমলাতন্ত্রের নয়, পুলিশেও চেইন অব কমান্ডের অভাব। সেখানেও নিচের দিকের কর্মকর্তারা উপরের দিকের কর্মকর্তাদের গুরুত্ব দেন না। তার মতে, এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাদারিত্ব। নিয়োগ থেকে শুরু করে পদায়ন, পদোন্নতিতে পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়কে নয়। এ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা মোটামুটি জানা, বঙ্গবন্ধুর আমলে আমলাতন্ত্র যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে, অনেক ক্ষেত্রে বিরোধিতাও করেছে। তিনি বলেন, আমলারা মনে করেন, ওই সময়ে তারা অবদমিত ছিলেন। মুজিব সরকার ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো- আমলাতন্ত্রের সহযোগিতা না পাওয়া। ওই সময়ে আমলারা ছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন, অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের অধীন।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এখন পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদদের ভূমিকা গৌণ। এ কারণেই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক পুরোপুরি বদলে গেছে। আমলাতন্ত্র এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সেই ভুলটি আর করবেন না, যেটি তার বাবা (বঙ্গবন্ধু) করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার ব্যাপারে পুরোপুরি সজাগ। তিনি জানেন কাকে আস্থায় নিতে হবে, কাকে খুশি রাখতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারি বলেন, গণতন্ত্রে নিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র থাকবে। ভিক্টোরিয়া সময়কালে গ্রেট ব্রিটেনে আমলাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করা হতো। অর্থাৎ স্বামী করবেন বাইরের কাজ আর স্ত্রী করবেন ঘরের সব কাজ। ঠিক রাজনীতিবিদরা বাইরের সব কিছু করবেন আর আমলারা প্রশাসনের কাজগুলো করবেন। কিন্তু আমাদের দেশে আমলারা মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা সিদ্ধান্ত দেন। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফাংশন করছে না।

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমলাদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের মধুর সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মিলিটারি শাসনামলে দেখা যায় আমলা এবং মিলিটারি শাসকদের মধ্যে এক ধরনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করলাম, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমলাদের সঙ্গে তাদের একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় আমলারা জনতার মঞ্চ করে বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করে। তখন থেকেই আমলাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

অধ্যাপক নুরুল আমিন বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমলাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এটি আরও খারাপের দিকে যায় সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর। ওই নির্বাচনে মন্ত্রী, এমপিসহ জনপ্রতিনিধিরা পুরোপুরি আমলা এবং পুলিশের কাছে বন্দী হয়ে গেছেন। এখন সবকিছু তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে গেলেই সেখানে আমলা ও পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। কোথাও কোথাও পুলিশ ও আমলারা বলে, আমরা আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়েছি। আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই হচ্ছে বর্তমান অবস্থা।

সর্বশেষ খবর