ভাষা একটি জাতির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের মূল ভিত্তি। এখন আমরা অনেকেই বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলি। অথচ ঔপনিবেশিক আমলে যে বিদেশিরা এখানে আসতেন এবং বাংলা শিখতেন, উইলিয়াম ক্যারি হোক বা অন্য বিদেশিরা- তারাও বিশুদ্ধ বাংলা বলার চেষ্টা করতেন। তাতে কিছু কিছু সমস্যা ও হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে ঠিকই, তবে তারা বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার মিশ্রণ ঘটাতেন না। এখনো অনেক বিদেশি আছেন যারা বাংলা শিখেছেন, তারা এটা পছন্দ করেন না। অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পাওয়া অর্থনীতিবিদ। তিনি বাংলায় বক্তৃতা করার সময় কখনো অন্য ভাষার শব্দ মেশান না। বাংলা ভাষায় আগে থেকে চালু হওয়া বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেন কিন্তু ইংরেজি আর বাংলা মিলিয়ে বলেন না। বড় মাপের মানুষ যারা তারা ভাষাকে এতটা গভীরভাবে আত্মস্থ করেন যে, তাদেরকে দুই-তিন ভাষা মিলিয়ে কথা বলতে হয় না। আমাদের তরুণদের সচেতন হতে হবে। সহজ, স্বাভাবিক, আন্তরিক পরিবেশে বাংলা ভাষায় বাংলা শব্দই ব্যবহার করতে হবে। বাংলা ভাষায় কিছু ইংরেজি, আরবি, পর্তুগিজ শব্দ ঔপনিবেশিক আমলে ঢুকে গেছে, সেটা আমাদের সাহিত্য ও ভাষারই অংশ হয়ে গেছে। এখন বাংলার সঙ্গে নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে উদ্ভটভাবে কথা বলা অনুচিত। আমাদের শিক্ষকদেরও উচিত ক্লাসে পড়ানোর সময় মাতৃভাষায় কথা বলা ও বলতে উৎসাহিত করা। দুই ভাষায় কথা বলার কারণে অনেক দেশই দুর্বল হয়ে গেছে। যেমন ফিলিপাইন। একাধিক ভাষার মিশ্রণে কথনভঙ্গি নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভাষার সৌন্দর্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভাষার প্রাণশক্তি শেষ পর্যন্ত থাকবে না। বাংলা সাহিত্যের কথা বললে, এর বিকাশ খুব খারাপ তা যেমন বলা যাবে না, আবার অসাধারণও বলব না। এখন তরুণ লেখকরা উঠে আসছে। তারা একই সঙ্গে স্বাধীন দেশের নবচেতনা, মানবিক বোধের গভীরতা, বিশ্বানুভূতি- এসব মিলিয়ে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করছে। সাহিত্যের আঙ্গিকে, বিষয়বস্তুতে এবং উপস্থাপনায় সেখানে তরুণরাও কিছু কিছু অভিনবত্বের সৃষ্টি করছে। এটা খুবই আশার কথা। বড় মাপের বা বিশ্বমানের সাহিত্যের কথা বললে আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত খুব একটা উপলব্ধি করতে পারছি না। বর্তমান সময়টা অত্যন্ত জটিল, আছে নানা রকম টানাপড়েনও। বিশ্বে নানা রকম সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থার মধ্যে নিজেকে সুস্থির রেখে যিনি সাহিত্যচর্চা করতে পারবেন তিনিই সফল হবেন। বিশ্বমানের সাহিত্য খুব সহজে হয় না। এই তো স্বাধীনতা পেলাম। পঞ্চাশ বছরও হয়নি। এই সময়ের মধ্যে খুব বড় মাপের সাহিত্য আশা করতে পারি না। এর জন্য সময় দিতে হয়। নতুন প্রজন্মের লেখকরা আসছে। অনেকের মধ্যেই সম্ভাবনা আছে। তাদের মধ্য থেকেই হয়তো বড় মাপের এক বা একাধিক সাহিত্যিক বেরিয়ে আসবে। আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত আলীর মতো সাহিত্যিক ছিলেন। আরও অনেকেই ছিলেন যারা আমাদের সাহিত্যকে অনেক সমৃদ্ধ করেছেন। সেই জায়গাটায় নতুন প্রজন্ম আসবে। সেটা ১০ বছর, ২০ বছর বা ১০০ বছর পরও আসতে পারে। আমরা ঔপন্যাসিক হিসেবে শওকত ওসমান, রশীদ করিম, আলাউদ্দীন আল আজাদ এবং পরবর্তীকালে এমন যারা এসেছেন তাদের সাহিত্যকর্মকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করছি। আমরা চাই আরও বড় মাপের সাহিত্য। নতুন দেশ, নতুন স্বাধীনতা, নতুন মানুষ, সেই সঙ্গে নতুন যুগ এবং সেই যুগটা অত্যন্ত জটিল। এরই প্রেক্ষাপটে খুবই বড় মাপের সাহিত্যিক আমাদের দেশে আসুক এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ