শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ঋণখেলাপিদের অর্থ কোথায় যায়

হচ্ছে ব্যাংকিং কমিশন, অর্থনীতি সম্পৃক্ত দাপুটে কাউকে আনার চিন্তা, খেলাপি বন্ধে কঠোর সরকার

মানিক মুনতাসির

ঋণখেলাপিদের অর্থ কোথায় যায়

সংসদে প্রকাশিত শীর্ষ ঋণখেলাপিরা ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থ কোথায় রেখেছেন বা কোন কাজে ব্যয় করেছেন তা অনুসন্ধান করছে সরকার। এদের মধ্যে যারা বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে যারা পাচার করা টাকায় বসবাস করছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর তাদের বিষয়েও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ৮ হাজার ঋণখেলাপির তথ্যসংবলিত একটি তালিকা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে গত বছরের জুনে সংসদে ৩০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়। এদিকে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হচ্ছে। দাপুটে কোনো অর্থনীতিবিদকে এ কমিশনের প্রধান করা হতে পারে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনকে। অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক-সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা হলে শীর্ষ ঋণখেলাপির অধিকাংশই স্বেচ্ছা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন। এর বেশির ভাগই ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করেননি। অনেকে ঋণের টাকার প্রায় পুরোটাই কোনো না কোনোভাবে পাচার করে দিয়েছেন। কেউ কেউ আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ওভার ইনভয়েস করে তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করে দিয়েছেন। আর সে টাকায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে। সেখানে তারা পাচার করা টাকায় বিলাসী-জীবন যাপন করছেন। সম্প্রতি শতাধিক ঋণখেলাপির বিষয়ে তদন্ত করে এমন প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংককেও দেওয়া হয়েছে। কমিশন মনে করে, অনেকেই পাচারের উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতারণা করে ভুয়া নাম-ঠিকানা, নামসর্বস্ব কোম্পানির  সাইনবোর্ড, ভুয়া দলিল-দস্তাবেজ ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা মেরে দিয়েছেন। বছরের পর বছর তা আর পরিশোধ করেননি। বরং সে টাকা বিদেশে নিরাপদে পাচার করে দিয়েছেন। এসব ঋণখেলাপিকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার কথা ভাবছে সরকার। যারা ইতিমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধবিষয়ক সংস্থাগুলোর কাছে সহায়তাও চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ তুলতে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে কঠোর একটি নতুন আইন করা হচ্ছে। এ আইনে যেসব ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হবে, তা আদায়ের ভার দেওয়া হবে সরকারের প্রস্তাবিত নতুন সংস্থা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনকে। সরকারের বিশেষায়িত এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণ আদায়ে সম্ভব সব ধরনের ক্ষমতা পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজন মনে করলে ঋণখেলাপির ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠানও বিক্রি করে দিতে কিংবা লিজ দিতে পারবে। ঋণখেলাপির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল, পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন, ঋণ পুনর্গঠনও করতে পারবে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন আইন, ২০২০’ নামে একটি আইনের খসড়াও ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করেছে। অন্যদিকে ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট ও হেয় প্রতিপন্ন করতে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ২০০৯ সংশোধন করা হচ্ছে। এরা যাতে বিলাসবহুলভাবে বিদেশ ভ্রমণ না করতে পারে সেজন্য তাদের তালিকা পাঠানো হবে বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে এদের ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ি ও বাড়ি রেজিস্ট্রেশন এবং ব্যবসা নিবন্ধনে। শুধু তাই নয়, খেলাপিদের যেসব পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং জেনারেল ম্যানেজার সুবিধা দেবেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ ধরনের কঠোর বিধান রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধন করছে সরকার। খসড়া আইনে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের যাতে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয় সেজন্য রাখা হয়েছে বিশেষ বিধান। জানা গেছে, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ কমছে না। দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টের সুবিধা খেলাপি ঋণ নিয়মিতকরণের সুযোগ দেওয়া হলেও খেলাপি ঋণ কমাতে তা তেমন কোনো কাজে আসেনি। এজন্য স্বভাবজাত ঋণখেলাপিদের ধরতে এ-সংক্রান্ত আইনগুলোয় কঠোর ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং কমিশন ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। ব্যাংক যেসব খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারবে না, সেগুলো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন আদায় করবে। এতে খেলাপি ঋণ অনেক কমে যাবে। এজন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। আইনটি করতে মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের আইন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে এই চার দেশ খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট আইন দিয়ে সফল হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়সংক্রান্ত এখন পর্যন্ত নেওয়া উদ্যোগগুলো তেমন কোনো কাজে আসেনি। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন করার কথা শোনা যাচ্ছে। এসব উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা নির্ভর করছে সরকার এগুলো কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে তার ওপর। কেননা কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা ছাড়া এ মুহূর্তে খেলাপি কমিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।

এদিকে দেশের ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে পারছে না। কিন্তু কাগজে-কলমে এবার খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, তিন মাসের ব্যবধানে ২২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে ফেলেছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গছে, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি গ্রাহক রয়েছে একাধিক গার্মেন্ট কোম্পানি। আছে চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিও। এ দুটি খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এরাই ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে মনে করে দুদক। সংসদে অর্থমন্ত্রীর প্রকাশিত ঋণখেলাপির তালিকায় বেশকিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এদিকে ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে বিলাসী-জীবন যাপন করছেন এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পি কে হালদার, ইসা বাদশা ও মুসা বাদশা। এর বাইরে অন্তত ২০০ জনের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যারা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। এদের অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর