রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুর মিছিলে ১৩ হাজার

নিউইয়র্কে দুই বাংলাদেশির মৃত্যু, আমেরিকান সীমান্ত সিল, ইতালির অবস্থা ভয়াবহ, আক্রান্ত ৩ লাখ ছাড়াল

প্রতিদিন ডেস্ক

করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা হু হু করে বেড়েই চলেছে। গতকাল সন্ধ্যারাত পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে ইউরোপের দেশ ইতালিতে। সেখানে নতুন করে মারা গেছেন ৭৯৩ জন। তবে এখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে ইরানকে ছাড়িয়ে গেছে স্পেন ও জার্মানি। এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র তার সব সীমান্ত সিল করে দিয়েছে। নিউইয়র্কে এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুই বাংলাদেশির মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। বিশ্বের এ অবস্থায় করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো। সেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কল্পনাতীত কমে এসেছে। এমনকি উহানের মানুষ করোনামুক্ত হওয়ায় আতশবাজি উৎসব পর্যন্ত করেছে। সূত্র : আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। ওয়ার্ল্ডোমিটারের  গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোট ১২ হাজার ৯৪৮ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২২৭ জন, সুস্থ হয়েছেন ৯৪ হাজার ৬২৫ জন। ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে মারা গেছেন ১ হাজার ৫৬৮ জন, নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ হাজার ৬৮০ জন। মৃতের মধ্যে রয়েছেন ইতালিতে ৭৯৩, স্পেনে ২৮৫, ইরানে ১২৩, নেদারল্যান্ডসে ৩০, বেলজিয়ামে ৩০, যুক্তরাষ্ট্রে ২৬, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮, চীনে ৭, ইন্দোনেশিয়ায় ৬, পর্তুগালে ৬, জার্মানিতে ৯, সিঙ্গাপুরে ২ জন, যুক্তরাজ্যে ৫৬ জন, সুইজারল্যান্ডে ১৬ জন, মালয়েশিয়ায় ৫ জন, ব্রাজিলে ৭ জন। এ ছাড়া কয়েকটি দেশে ১/২ জন করে মারা গেছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় নিউইয়র্ককে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ সময় ওষুধের দোকান, মুদি দোকানের মতো জরুরি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব বন্ধ থাকবে। কর্মচারীদের প্রয়োজনে ঘরে থেকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সময় শুক্রবার সকালে নিউইয়র্কের রাজ্য গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো লকডাউনের এ ঘোষণা দেন। এ নির্দেশনা স্থানীয় সময় রবিবার রাত ৮টা থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। আদেশ লঙ্ঘনকারীদের জরিমানা গুনতে হবে। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ১০০ ছাড়িয়েছে। প্রতি মুহূর্তে এ সংখ্যা বাড়ছে। ২০ মার্চ সকাল পর্যন্ত নিউইয়র্কে মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৫। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২২ হাজার ১৩২ জন। অন্তত ২৮২ জন মারা গেছেন।

এ ছাড়া করোনাভাইরাসের দ্রুত বিস্তার রোধে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সীমান্ত সিল করে দিয়েছে। বলা হয়েছে, এ অবস্থায় পাশের কানাডা-মেক্সিকো থেকে কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া সাম্প্রতিককালে চীনে সফরে গেছেন এমন বিদেশিদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কে দুই বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তারা দুজনই কুইন্সের বাসিন্দা ছিলেন। এস্টোরিয়া এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব একজন গত বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান। হার্টের সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কুইন্সের একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। অন্যজন কুইন্সের উডসাইডের বাসিন্দা ছিলেন। পেশায় গ্রিন ক্যাবের চালক ছিলেন। তার বয়স ৫০ বছর। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, করোনাভাইরাস এখন নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেক বাংলাদেশির এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর লোকমুখে শোনা গেলেও ঠিক কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের পরিবার বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চাইছে। আশপাশ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কোনো কোনো ব্যক্তির আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা যাচ্ছে। জানা গেছে, নিউইয়র্কের একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। এ নিয়ে ২১ জন বাংলাদেশি প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের এক ইতালি প্রবাসী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেছেন। শুক্রবার দিবাগত রাতে ইতালির মিলান সিটির নিগোয়ারদা হাসপাতালে তিনি মারা যান।

হোয়াইট হাউসে করোনার হানা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারি কার্যালয় ও বাসভবনেও হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। হোয়াইট হাউসের বিবৃতির বরাতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের এক কর্মী ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। পেন্সের মুখপাত্র কেটি মিলার বিবৃতিতে জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় তারা ভাইস প্রেসিডেন্টের অফিসের এক কর্মী করোনায় আক্রান্ত বলে জানতে পারেন। বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে যাননি।

ইতালির অবস্থা ভয়াবহ : করোনাভাইরাস মহামারীর কয়েকদিনে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ইতালি। দেশটিতে সংকট ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হয়ে চলেছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিচ্ছে সরকার। দেশটির উত্তরাঞ্চলে অবরুদ্ধ পরিস্থিতি (লকডাউন) বজায় রাখতে রাস্তায় সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। একজন কর্মকর্তা জানান, ইতালির করোনায় আক্রান্ত লোমবার্ডি অঞ্চল। করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখানেই মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্য করছেন চীনের রোগ বিশেষজ্ঞরাও। তারা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে এ অঞ্চলে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার থেকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় আঞ্চলিক সরকার।

ইরানকে ছাড়িয়ে গেল স্পেন-জার্মানি : করোনা মহামারীতে যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ইউরোপ। এ অঞ্চলের দেশগুলোয় প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এক দিন আগেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় ইরানের পেছনে ছিল স্পেন ও জার্মানি। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশ দুটিতে কয়েক হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হওয়ায় এখন সর্বোচ্চ আক্রান্তের তালিকায় ৩ ও ৪ নম্বরে উঠে এসেছে দেশ দুটি।

ইরানেও গত ২৪ ঘণ্টায় বেড়েছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এ সময়ে দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে ১৪৯ জনের, আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৩৭ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৫৬-এ, আক্রান্ত ২০ হাজার ৬১০ জন। তবে ইরানের তুলনায় স্পেনে এক দিনে আক্রান্ত বেড়েছে প্রায় তিন গুণ ও জার্মানিতে চার গুণ। গত ২৪ ঘণ্টায় স্পেনে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৩৩ জন, মারা গেছেন ২৮৫ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৩৭৪-এ, মৃত্যুর ঘটনা ১ হাজার ৩৭৮টি।

জার্মানিতে ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৬ জন, মারা গেছেন ৯ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৮৫৪-এ, মারা গেছেন মোট ৭৭ জন।

আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও স্পেন-জার্মানির চেয়ে ইরানে সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যা অনেক বেশি। ইরানে এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৬৩৫ জন করোনামুক্ত হয়েছেন, স্পেনে হয়েছেন ২ হাজার ১২৫ জন আর জার্মানিতে এ সংখ্যা মাত্র ২০৯।

অল্পবয়সীরাও ঝুঁকিতে : তরুণরাও করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত শুক্রবার জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান কার্যালয় থেকে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান টেড্রস অ্যাডহানম গেব্রেইয়েসুস বলেন, যদিও বয়স্ক ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি আঘাত পান, তবু অল্পবয়স্ক লোকদের এড়ানো যায় না। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তরুণদের জন্য আমার একটি বার্তা আছে- তোমরা অজেয় নও। এ ভাইরাস তোমাদের কয়েক সপ্তাহের জন্য হাসপাতালে পাঠাতে পারে। এমনকি মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দিতে পারে। হয়তো তোমাদের অসুখ হবে না।

কিন্তু তোমাদের অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরা আরেকজনকে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে ঠেলে দিতে পারে।’ চীনের উহান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘উহান শহর এখন বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে আশার আলো দেখাচ্ছে। সেখানে এখন আর নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হচ্ছে না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর