রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগীর করোনা শনাক্ত হওয়ায় লকডাউন করা হয়েছে হাসপাতালের প্যাথলজি, রেডিওলজি ও শিশু বিভাগ। মেডিকেল কলেজের প্যাথলজিতে চলছে হাসপাতালের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। করোনা পজিটিভ রোগীদের তথ্য গোপনে লকডাউনের কবলে পড়েছে হাসপাতালগুলো। ফলে স্বাস্থ্যসেবা কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
শুধু এ হাসপাতাল নয়, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনি বিভাগে রোগী ভর্তি বন্ধ রয়েছে। বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ লকডাউন করা হয়েছে। করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় কর্তৃপক্ষকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল স্টোর, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষ, কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট, মেডিসিন ১৪ নম্বর ওয়ার্ড লকডাউন করা হয়েছে। জেলার গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগ ছাড়া যাবতীয় সেবা বন্ধ রয়েছে। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নম্বর মেডিসিন ইউনিট লকডাউন করা হয়েছে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায়। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স লকডাউন করা হয়েছে। রোগী থেকে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন করে রোগী শনাক্তে স্ক্রিনিং চালাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হওয়ায় অচল হয়ে পড়ছে স্বাস্থ্যসেবা।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাসপাতালের ৪০ জন ডাক্তার, সাতজন নার্স ও ১০ জন স্বাস্থ্যকর্র্মী এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আরও ৪০ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন কোয়ারেন্টাইনে। রোগী কম থাকায় সেবা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু রোগী বাড়লে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। রাজধানীর সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে এক রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। রোগীর স্বজনরা জানান তারা মাদারীপুর থেকে রোগী নিয়ে এসেছেন। অপারেশনের পর জিজ্ঞাসা করলে রোগী বলেন তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। কভিড-১৯ টেস্ট করলে দেখা যায় রোগী আক্রান্ত। তাকে সেবা দেওয়া সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পাঁচজন চিকিৎসক, চারজন নার্স ও তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী প্রথমে করোনা সংক্রমিত হন। এরপর তাদের সংস্পর্শে আসায় বর্তমানে ওই হাসপাতালের ৩৫ জন চিকিৎসক, ১৫ জন নার্স ও ১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ-উন-নবী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ ৬৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আরও অনেকেই কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। একসঙ্গে অনেকে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় গাইনি বিভাগে রোগী ভর্তি বন্ধ ছিল। অনেকেই সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে শুরু করেছেন। খুব দ্রুত সেখানে রোগী ভর্তি শুরু করব আমরা।’ বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ লকডাউন করা হয়েছে। আইসিইউতে ভর্তি থাকা চারজন রোগী করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ ওই ইউনিট লকডাউন করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্টোরের এক কর্মী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ওই স্টোর লকডাউন করা হয়েছে। রাজধানীর ডেল্টা হাসপাতালের আইসিইউতে এক করোনা আক্রান্ত রোগী মারা যান। পরে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় হাসপাতালটি লকডাউন করা হয়। ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালে দুই ডাক্তার, নার্সসহ নয়জন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ওই হাসপাতাল লকডাউন করা হয়। রাজধানীর বাইরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় তিনটি ইউনিট লকডাউন করা হয়েছে। আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি সৈয়দ নোমান জানান, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ পর্যন্ত ২৯ জন চিকিৎসক, ১৭ জন নার্স ও ১৮ জন স্টাফ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। ১৬ এপ্রিল শেরপুরের এক প্রসূতি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের তথ্য গোপন করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি ওয়ানস্টপ সার্ভিস হয়ে গাইনি বিভাগ, অস্ত্রোপচার কক্ষ ও আইসিইউ বিভাগে চিকিৎসা নেন। পরদিন তিনি সন্তান প্রসব করেন। এরপর তার অবস্থার অবনতি হলে পরীক্ষায় ধরা পড়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত। সেখান থেকে চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফরা আক্রান্ত হন। এরপর মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা আরেক রোগী করোনা শনাক্তপ্রণ। একইভাবে কিডনি ডায়ালাইসিস করার পর রোগী শনাক্ত হয়। তাই সংক্রমণ ঠেকাতে গাইনি অস্ত্রোপচার কক্ষ, কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট ও মেডিসিনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড লকডাউন করে কর্তৃপক্ষ। জেলার গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক-নার্সসহ আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন। জরুরি সেবা ছাড়া হাসপাতালের অন্য কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। বরিশাল থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক রাহাত খান বলেন, বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তথ্য গোপন করে এক করোনা রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তাকে সেবা দেওয়া একজন চিকিৎসক, পাঁচজন ইন্টার্ন চিকিৎসক ও একজন নার্স করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সংক্রমণ ঠেকাতে হাসপাতালের ৩ নম্বর মেডিসিন ইউনিট লকডাউন করেছে কর্তৃপক্ষ। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস বলেন, এ পর্যন্ত বরিশালে ১০ জন চিকিৎসকসহ ২২ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। বরিশাল বিভাগে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১১১ জন। করোনায় মারা গেছেন পাঁচজন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৩৫৯ জন চিকিৎসক, ১৭৯ জন নার্সসহ ২৯৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৮৩১ জন স্বাস্থ্যকর্মী সেবা দিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।’ প্রতিদিন গড়ে ১০০ স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। ব্যাপকহারে স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য।