বুধবার, ৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

আবাসন সংশ্লিষ্ট ২১১ খাত হুমকিতে

প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, ঝুঁকিতে ৫৯ লাখ নির্মাণশ্রমিক

রুহুল আমিন রাসেল

আবাসন সংশ্লিষ্ট ২১১ খাত হুমকিতে

আবাসনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্প খাত হুমকিতে পড়ার তথ্য দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, মহামারী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রভাবে স্থবির আবাসন খাত। ফলে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, কনস্ট্রাকশন, স্যানিটারি, সিরামিক, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যাবল ও লাইটিং শিল্পের মতো ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাতে নেমেছে বিপর্যয়। চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তায় পড়েছে ৫৯ লাখ নির্মাণশ্রমিকের কর্মসংস্থান। জানা গেছে, মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে আবাসনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ২১১ ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্প খাত স্থবির। এসব খাতে দুই হাজারেরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকিতে পড়েছে। ওই ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের মধ্যে রয়েছে ২৭টি কনস্ট্রাকশন সামগ্রী খাত এবং ৪৩টি বাথ ও কিচেন ফিটিংস পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহকারী খাত। আরও আছে ৪৪টি ইলেকট্রিক্যাল, ৪৪টি ফার্নিচার, ১৮টি সার্ফেজ ফার্নিশিংসহ আরও অনেক ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প। এসব খাতের মধ্যে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে দেশের সিমেন্ট, রড, স্টিল ও রি-রোলিং মিলস, সিরামিক ও টাইলস, কেমিক্যালস, ইট, বালু, পাথর, পিভিসি পাইপ, উড, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, কিচেন ফিটিংস, গ্যাস স্টোভ, ওয়াটার হিটার, আয়রন, ফ্লাশিং ইকুইপমেন্টস, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, ট্রান্সফরমার, লাইট, ক্যাবলস, ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনার, এয়ার কুলার, বিল্ডিং ইন্সটলেশন, গ্লাস ডোর, টিমবার, ইলেকট্রিক্যাল সিকিউরিটি ডোর, বিল্ডিং সেফটি, মোজাইক, পেইন্ট, সিরামিকের বিভিন্ন পণ্য, বিভিন্ন ধরনের পাইপ, ফিটিংস, কাচ ও কাচজাতীয় অন্যান্য পণ্য, পাথর ও পাথরজাত পণ্য, পেইন্ট, লোহাজাতীয় বিভিন্ন পণ্য, আসবাবপত্র ও কাঠজাত বিভিন্ন পণ্য, প্লাইউড, বৈদ্যুতিক ফিটিংস ও অন্যান্য সামগ্রী, নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, আঠাজাতীয় বিভিন্ন পণ্য, স্টিলজাত পণ্য, অ্যালুমিনিয়াম খাতের মতো ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্প। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আবাসন খাতে হুমকিতে পড়ায় বিপর্যয় নেমেছে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পেও। এসব খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, আবাসন খাত সচল হলেই ঘুরে দাঁড়াবে লিঙ্কেজ শিল্প। এ ছাড়া আবাসন কোম্পানিগুলোতে ২০ হাজার নির্মাণকাজ ব্যবস্থাপক, ১০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, তিন হাজার স্নাতক প্রকৌশলী এবং প্রায় ৫০০         স্থপতি নিয়োজিত আছেন। এ প্রসঙ্গে আবাসনশিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে ৬৬ দিনের লকডাউনে আবাসনশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ২১১টি সহযোগী শিল্প পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়েছে। জানি না এই ভয়াবহ ধাক্কা কত দিনে সামলাতে পারব। কিন্তু এটুকু বলতে চাই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবাসন খাত ও সহযোগী শিল্প চালু রাখতে হবে। আবাসনশিল্প সচল হলেই ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। অর্থনীতিতে নতুন টাকার সরবরাহ ও সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে আসছে ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে আগামী পাঁচ বছরের জন্য বিনা প্রশ্নে বৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিত টাকা বিনিয়োগের সুযোগ চাই।’ বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘শুনছি সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা কাটছাঁট করবে। এটা করা হলে সিমেন্ট শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া সিমেন্ট খাতকে প্রণোদনা দিলেও এখানো বাংলাদেশে এমন কিছু দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমরা চাই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চলমান রাখা হোক। অন্যথায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখন করোনা মহামারী চলছে। সামনে অর্থনৈতিক মহামারী শুরু হবে। ফলে আমরা বেশ খারাপ অবস্থায় আছি। এত বড় ধাক্কা সহজে সামলানো যাবে না। কারণ অর্থনীতিতে টাকার সরবরাহ নেই। ব্যাংকগুলো টাকা সরবরাহে অনীহা দেখাচ্ছে। তাই হাত গুটিয়ে রাখা ব্যাংকগুলোর ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।’ মহামারী করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে নতুন বাজেট সামনে রেখে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে দেওয়া পত্রে আবাসনশিল্পের বিনিয়োগকারীদের মূলধন বা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদান অনুরোধ করেছে রিহ্যাব। সংগঠনটি বলেছে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমগ্র নির্মাণ খাতের অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ। বর্তমানে এই আবাসনশিল্প একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছে। নির্মাণ খাত দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবাসনশিল্পের ৩৫ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

রিহ্যাব বলেছে, আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ ক্রেতাদের কিস্তির ওপর ভিত্তি করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। অধিকাংশ ডেভেলপারের সঙ্গে তফসিলি ব্যাংকের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সুযোগ-সুবিধা নেই। তারা নিজ নিজ বিনিয়োগ এবং ক্রেতার কিস্তির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। করোনার প্রভাবে ক্রেতারা কোনো কিস্তি দিচ্ছে না। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা না থাকার কারণে ডেভেলপাররা গভীর সংকটে পড়েছেন। অফিস পরিচালনা, নির্মাণকাজ এবং দৈনন্দিন জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। এমতাবস্থায় সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বরাদ্দ প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছে রিহ্যাব।

বাংলাদেশ কনস্ট্রাকশন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন চৌধুরী জুয়েল বলেন, ‘কনস্ট্রাকশনের জন্য কোনো ঋণ নেই। ক্রেতারা কিস্তির টাকা দিতে পারছে না। একটা দোদুল্যমান অবস্থা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে আসছে বাজেটে আবাসন খাতে বিশেষ বরাদ্দ ও রেজিস্ট্রি খরচ কমানোর দাবি করছি।’

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতিতে কাজ না থাকায় জীবনযাপনে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন দেশের প্রায় ৫৯ লাখ নির্মাণশ্রমিক। দেশের অবকাঠামো নির্মাণকারী কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এ খাতের প্রায় ৩৪ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ এখন অজানা। আছে ছাঁটাই, চাকরি হারানো ও বেকারত্বের শঙ্কা। আবার আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিক এখন কর্মহীন। এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা উদ্যোক্তাদের। কনস্ট্রাকশন ও আবাসনশিল্প মিলিয়ে প্রায় ৫৯ লাখ নির্মাণশ্রমিকের কর্মসংস্থান এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

জানা গেছে, আবাসন ও কনস্ট্রাকশন শিল্পের সঙ্গে রড, সিমেন্ট, সিরামিক, পেইন্টসহ অনেক শিল্প খাত জড়িত। কীভাবে করোনাভাইরাসের এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে তা কেউ বলতে পারছেন না। আবাসন ও কনস্ট্রাকশন খাতে আরও ধাক্কা আসতে পারে। কবে নাগাদ এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে, এর উপায় দেখছেন না উদ্যোক্তারা। এ অবস্থায় আবাসন খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চান উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, আবাসন খাত পদে পদে যেসব হয়রানির শিকার হচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণ দেওয়াটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। প্রকল্প অনুমোদনের সব প্রক্রিয়া সহজীকরণ করতে হবে। নীতি সহায়তার সঙ্গে কর প্রণোদনাও প্রয়োজন। এগুলো সরকার ইতিবাচকভাবে দেখলেই ঘুরে দাঁড়াবে আবাসন খাত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিপদগ্রস্ত নির্মাণশ্রমিকরাও রক্ষা পাবেন। এখন নির্মাণশ্রমিকদের ভাগ্য অনিশ্চিত।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সভাপতি প্রকৌশলী এস এম খোরশেদ আলম মনে করেন, করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা দেশের কনস্ট্রাকশন খাতের সব কাজ বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অজানা। ৫০ শতাংশ কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ধরে রাখতে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের স্বার্থে উন্নয়ন কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশ টাইলস ডিলার অ্যান্ড ইম্পোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘খুব অসহায় অবস্থায় আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ আবাসনশিল্পে এখন চরম মন্দা বিরাজ করছে। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো চালু না হলে আমরা কার কাছে পণ্য বিক্রি করব!’

সর্বশেষ খবর