মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

বুড়িগঙ্গায় লাশের ভেলা

উদ্ধার ৩২ মরদেহ, নিখোঁজ অনেকে । ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় ডুবল মর্নিং বার্ড । তদন্ত কমিটি । মাতম মুন্সীগঞ্জে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বুড়িগঙ্গায় লাশের ভেলা

দোতলা ছোট লঞ্চ মর্নিং বার্ড। অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে মুন্সীগঞ্জ থেকে নিরাপদেই ঢাকার সদরঘাটে এসে পৌঁছে। গন্তব্যস্থল শ্যামবাজার কাঠপট্টি ঘাট থেকে লঞ্চটির দূরত্ব আর মাত্র ২০০ হাত। লঞ্চের যাত্রীরা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তীরে ভেড়া হলো না। পেছনের দিকে আসতে থাকা দৈত্যাকার ময়ূর-২ লঞ্চ ছোট মর্নিং বার্ডকে সজোরে ধাক্কা দেয়। তাতেই কাত হয়ে ডুবতে থাকে লঞ্চটি। মহাবিপদের আঁচ করতে পারা যাত্রীদের তখন গগনবিদারী আর্তনাদ। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারে প্রকম্পিত হয় বুড়িগঙ্গার দুই তীর। সে চিৎকার বেশিক্ষণের নয়। মুহূর্তে ডুবন্ত ছোট লঞ্চটির ওপর পুরো দেহ উঠিয়ে দেয় ময়ূর। তলিয়ে যায় যাত্রীভর্তি আস্ত লঞ্চটি। যাত্রীদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগই পায়নি। কিছু সময় পরই একে একে ভেসে উঠতে থাকে লাশ। শিশুর লাশ ভাসতে থাকে একদিকে। সেটি নৌকায় তুলতেই দেখা মেলে নারীর লাশ। সেটি তুলতেই ভেসে ওঠে পুরুষের লাশ। মাঝনদীতে নৌযানে সারি করে রাখা হয় লাশগুলো। বুড়িগঙ্গায় যেন লাশের ভেলা। প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে ধৈর্যের বাঁধ মানেনি স্বজনদের। নৌকা নিয়ে ছুটে যান মাঝনদীতে সারি করে রাখা লাশের কাছে। বুকভাঙা কান্নার কাছে নিজেদের সঁপে দিচ্ছিলেন প্রিয় মানুষ হারানো স্বজনরা। তাদের বুক চাপড়ানো আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বুড়িগঙ্গার আকাশ-বাতাস। নদীর দুই তীরে কেউ প্রিয়জনের লাশ পেয়ে কাঁদছেন, কেউ এপাশ-ওপাশ ছোটাছুটি করছেন স্বজনের খোঁজ না পেয়ে। ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ, নৌবাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩২ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন। সবাই মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। যারা অফিসগামী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার।

গতকাল সকালে রাজধানীর অন্যতম প্রবেশদ্বার সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় লঞ্চডুবির মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ ময়ূর লঞ্চটি জব্দ করলেও চালক পালিয়েছেন। বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে তাদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সর্বক্ষণ উদ্ধারকাজের খোঁজখবর রাখছেন বলে তাঁর দফতর থেকে জানানো হয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। লঞ্চডুবির ঘটনায় মৃতদের পরিবারগুলোকে দেড় লাখ টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দেন তিনি। লাশ দাফন-কাফনের জন্য তৎক্ষণাৎ ১০ হাজার করে টাকা দেওয়ার কথাও জানান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাড় দেওয়া হবে না।’

এ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। যুগ্মসচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক ও বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে গঠিত এ কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা রোজিনা ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার পর তাদের ডুবুরি দল উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। পাশাপাশি নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরাও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। তারা ঘটনাস্থল থেকে ৩০টি মৃতদেহ উদ্ধার করেন। এ ছাড়া স্থানীয়রা আরও দুজনকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন বলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার জানান।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, দুই লঞ্চের কর্মীদের অসতর্কতায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন। উদ্ধার অভিযান শেষে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা : ২০ বছর ধরে রোজ লঞ্চের যাত্রী হয়ে সকালে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন দুই বন্ধু সত্যরঞ্জন বণিক আর আবদুর রউফ। কাজ শেষে আবার বিকালে ফিরে যান। প্রতিদিনের মতো গতকালও সকাল সাড়ে ৭টায় মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে মর্নিং বার্ডে তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে লঞ্চটি সদরঘাট টার্মিনালের কাছাকাছি চলে আসে। লঞ্চটি তখন ঘাট থেকে ২০০ হাত দূরে ছিল। যাত্রীরা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখনই ময়ূর পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মর্নিং বার্ড তলিয়ে যায়। সত্যরঞ্জন মারা গেলেও ভাগ্যগুণে বেঁচে যান আবদুর রউফ। কীভাবে লঞ্চটি ডুবে গেল, সে ব্যাপারে আবদুর রউফ সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চটি সদরঘাটের একেবার কাছে চলে আসে। আমরা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘাটের খালি একটি লঞ্চ আমাদের লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়। ভয়ে আমরা সবাই চিৎকার দিই। ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের লঞ্চটি উল্টে যায়। আমরা ছিলাম লঞ্চের নিচের তলায়। পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকি। দম আমার বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি পানির ওপরে উঠতে পারি। বেঁচে যাই। তবে আমার বন্ধু সত্যরঞ্জন উঠতে পারেননি, তিনি মারা যান। আবেগাপ্লুত আবদুর রউফ জানান, যারা মারা গেছেন বা ডুবে গেছেন, তাদের অনেককে তিনি ভালো করে চেনেন। কারণ এসব মানুষ মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসেন। কাজ শেষে আবার চলে যান। আবদুর রউফ বলেন, ‘আমাদের লঞ্চটিতে ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী ছিলেন। নিয়ম মেনে ঘাটে ভেড়াচ্ছিল। হঠাৎ অন্য লঞ্চটি ধাক্কা দিয়ে এদের মেরে ফেলল। আমিও মরে যেতে পারতাম।’ সত্যরঞ্জনের বড় মেয়ে দোলা বণিক বলেন, ‘আমার বাবার মিটফোর্ডে দোকান আছে। আমি থাকি ঢাকায়। বাবা প্রতিদিন মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। আবার কাজ শেষে চলে যান। গত পরশু বাবা আমার বাসায় আসেন। আমি বাবাকে বলি, এখন করোনাভাইরাস। তুমি লঞ্চে যাতায়াত কোরো না। আমার বাসায় থেকে ব্যবসা কর। কিন্তু বাবা কথা শুনলেন না। চলে গেলেন!’ বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক মো. সেলিম জানান, মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ডে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিলেন বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই ভিতরে আটকা পড়েন। তবে ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বিকালে বলেন, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কাছাকাছি নদীর মাঝখানে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উল্টে রয়েছে। তাই ভিতরে কোনো মৃতদেহ আছে কিনা তল্লাশি করা যায়নি। কথা ছিল তল্লাশি শেষ হলে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী নৌযান ডুবে যাওয়া লঞ্চটি টেনে তুলে সরিয়ে নেবে। কিন্তু বাবুবাজার ব্রিজের নিচ দিয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ আসতে না পারায় তা সম্ভব হয়নি।

প্রাণ গেল যাদের : দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজামান জানান, যে ৩২ জনের লাশ মর্গে এসেছে, তার সবাইকে শনাক্ত করে পরিবারে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের সবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়।

তারা হলেন শাহাদাত হোসেন (৪৪), আবু তাহের বেপারী (৫৮), সুমন তালুকদার (৩৫), ময়না বেগম (৩৫), তার মেয়ে মুক্তা আক্তার (১৩), আফজাল শেখ (৪৮), মনিরুজ্জামান মনির (৪২), গোলাপ হোসেন (৫০), সুবর্ণা বেগম (৩৮), তার ছেলে তামিম (১০), আবু সাঈদ (৩৯), সুফিয়া বেগম (৫০), শহিদুল ইসলাম (৬১), মিজানুর রহমান কনক (৩২), সত্যরঞ্জন বণিক (৬৫), শামীম বেপারী (৪৪), বিউটি আক্তার (৩৮), আয়েশা বেগম (৩৫), মিল্লাত (৩৫), আমির হোসেন (৫৫), সুমনা আক্তার (৩২), পাপ্পু (৩২), মো. মহিম (১৭), দিদার হোসেন (৪৫), হাফেজা খাতুন (৩৮), হাসিনা রহমান (৩৫), সিফাত (৮), আলম বেপারী, তালহা (২), ইসমাইল শরীফ (৩৫), সাইফুল ইসলাম (৪২) ও বাসুদেব নাথ (৪৫)।

শোক : বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। শোক প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম প্রমুখ।

গভীর শোক জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শোকবার্তা পাঠিয়েছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বুড়িগঙ্গায় যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনায় মুন্সীগঞ্জে মাতম বইছে। এ ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মৃণালকান্তি দাস, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের এমপি অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলি, জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার, পুলিশ সুপার আবদুল মোমেন, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান, মীরকাদিম পৌর মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম শাহীন শোক প্রকাশ করেছেন। এদিকে মীরকাদিমের মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহীন একে দুর্ঘটনা না বলে পরিকল্পিত হত্যা দাবি করে বিচার চেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে নিহতদের বেশিরভাগেরই বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। লঞ্চ দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে রক্ষা পেয়ে মুন্সীগঞ্জের জাহাঙ্গীর হোসেন ও নাসিমা আক্তার বলেন, কেরানীগঞ্জের ডকইয়ার্ড থেকে মেরামত শেষে ময়ূর-২ লঞ্চটি নদীতে নামানোর সময় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি থেকে আমরাসহ কয়েকজন যাত্রী সাঁতরে পাড়ে উঠলেও এখনো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর