শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
মন্তব্য কলাম

এ কি কাণ্ড ঘটাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

এ কি কাণ্ড ঘটাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের যে ছবি জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়েছে তা দিয়ে কয়েক ডজন পিএইচডির থিসিস লেখা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে ভৌতিক ঘটনা হলো, আইনের দৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন রিজেন্ট হাসপাতাল নামক একটি ভুয়া হাসপাতালের সঙ্গে অবৈধ চুক্তি করে সেই ভুয়া হাসপাতালকে আকাশচুম্বী অবৈধ মুনাফার ব্যবস্থা করে দেওয়া। স্বীকৃতমতে ওই ভুয়া হাসপাতালটি গত ছয় বছর ধরে লাইসেন্সবিহীনভাবে মহাদাপটের সঙ্গে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্ঞাতসারে। এখানে বলে রাখা উচিত, যে হাসপাতাল লাইসেন্স নবায়ন করেনি সেটি সোজা কথায় লাইসেন্সবিহীন, যাকে আইনগতভাবে মোটেও হাসপাতাল বলা যায় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অবৈধ চুক্তির ভিত্তিতে ওই হাসপাতাল করোনামুক্ত সনদ প্রদান করত বহু পয়সার বিনিময়ে। অপরাধমূলক এ কর্মকান্ডে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু রোগী, অন্যদিকে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি। গত পরশু ইতালি সরকার বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে ফেরা শতাধিক বাঙালিকে ফেরত পাঠিয়েছে। কারণ তাদের অনেকেই ছিল করোনা আক্রান্ত অথচ প্রত্যেকের সঙ্গেই ছিল করোনামুক্ত সনদ। এ ধরনের ভুয়া সনদ যে শুধু রিজেন্ট নামক ভুয়া হাসপাতালই দিত তা নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আশীর্বাদে আরও অনেক হাসপাতালই এ ধরনের ভুয়া সনদ দিয়েছে। এর ফলে শতাধিক বাঙালি ইতালিতে ফিরতে পারল না শুধু তাই নয়, এর প্রতিক্রিয়া আরও সম্প্রসারিত হতে পারে, মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার এমনকি রপ্তানি বাণিজ্যও। উল্লেখ্য, ছয় বছর বেআইনি বাণিজ্য করা সত্ত্বেও এই ভুয়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর গ্রহণ না করে একে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে। এমনকি মিথ্যা সনদের অভিযোগটিও কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর করেনি, এটির কৃতিত্ব একান্তই র‌্যাবের। তারাই স্বতঃপ্রণোদিত অভিযান চালিয়ে বিশাল এ অপরাধ চক্রের মুখোশ উন্মোচন করেছে। এর আগেও বিভিন্ন সংস্থা এবং বেসরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন অপরাধের তথ্য বেরিয়ে আসার পরও এ মন্ত্রণালয় অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ভুয়া মুখোশ বিতরণকারী জেএমআই মালিক আবদুর রাজ্জাক, মিঠু সিন্ডিকেট ইত্যাদির বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, বরং এদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের অবহেলার কারণে পাঁচজন রোগীর মৃত্যুর পরও এবং সে হাসপাতালটি অপরাধমূলকভাবে লাশ জিম্মি করে রাখার পরও স্বাস্থ্য অধিদফতর হাসপাতালের বিরুদ্ধে না করেছে কোনো ফৌজদারি মামলা, না হাসপাতালটির লাইসেন্স বাতিল- যে ক্ষমতা ১৯৮২ সালের আইন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে। সম্প্রতি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল এবং চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন হাসপাতাল ভুতুড়ে বিল করার মতো অপরাধের পরও স্বাস্থ্য অধিদফতর এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার প্রক্রিয়া শুরু করেনি এবং এদের লাইসেন্স বাতিল করেনি। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য হাই কোর্টে রিট করতে হয়েছে, দুদকে ইয়াদিয়া জামানসহ কয়েকজন অ্যাডভোকেটকে নালিশ দায়ের করতে হয়েছে। অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করার আগে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। যে হাসপাতালের লাইসেন্স ছয় বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ, সে হাসপাতাল যে লাইসেন্সবিহীন, তা যে কোনো সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের জানার কথা। এটা জানার জন্য আইনজ্ঞ হতে হয় না। এই কর্মকর্তা তথা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অন্যদের যদি এতটুকু সাধারণ জ্ঞান না থাকে তাহলে তা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। এটা না জানলে তাদের উচিত ছিল আইন মন্ত্রণালয় বা অ্যাটর্নি জেনারেলের পরামর্শ চাওয়া। যে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি, তা যে আইনের দৃষ্টিতে অস্তিত্ববিহীন তা সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন কাউকে বোঝানোর প্রয়োজন হয় না। সুতরাং যে লাইসেন্সের অস্তিত্বই নেই, সে লাইসেন্স বাতিল করার কথা বলা বাতুলতা মাত্র।

ইতিবাচক দিক হলো এই যে, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক এরই মধ্যে জেএমআই কোম্পানির আবদুর রাজ্জাক, মিঠু সিন্ডিকেটের মিঠুসহ কয়েকজনকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তলব করেছে। এ ছাড়া মাননীয় হাই কোর্টও কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এ অবস্থায় দুদকের কাছে সবার দাবি : ভুয়া হাসপাতাল মালিকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে শীর্ষে অবস্থান করে যারা দুর্নীতিভিত্তিক অপরাধে গা ভাসিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে যেন তদন্ত শুরু করা হয়। শোনা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে অপসারণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আগের সচিবকে সরানো হয়েছে। আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকেও সরানো হয়েছে। কিন্তু অপসারণই যথেষ্ট নয়। সব দুর্নীতিবাজকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা এই জনপ্রিয় সরকার এবং জনদরদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দল ও সরকারের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে নষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কাঠোর অবস্থানে যেতে হবে। বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার কঠিন আবর্তে পতিত হতে পারে, এমনকি ছাত্র হিসেবেও অনেক জনের বিদেশে প্রবেশ অনিশ্চিত হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দিনদুপুরে ডাকাতিসম এ ধরনের অবিশ্বাস্য কাজটি কীভাবে এবং কীজন্য করতে পারল? এর জন্য দায়ী কারা? নেটিজনদের যৌক্তিক দাবি হলো এই যে, রিজেন্ট নামক ভুয়া হাসপাতালের মালিক সাহেদ নামক এক স্লামডগ মিলিয়নিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের পকেট ভারী করে এ ধরনের দুর্নীতিতে গা ভাসাতে পেরেছেন। সুতরাং তদন্ত অবশ্যই হতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষজনদের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগে ঔষধ অধিদফতরের বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সচিবের কাছে এক চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পুত্র তার পছন্দের লোকদের নিয়োগ এবং বদলি করতেন, তার নিজস্ব সুবিধার জন্য। ঊর্ধ্বতন এক সামরিক কর্মকর্তার কথা অবিশ্বাস করা যায় না এজন্য যে, তিনি এখনো চাকরিরত। তাই তিনি এমন কোনো কথা লেখার সাহস পেতেন না যা সত্য নয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক, বিশিষ্ট সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন- দুর্নীতিবাজদের হাত বড় না আইনের হাত বড়? তার এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে দুদককে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, আইনের হাত দুর্নীতিবাজদের হাতের চেয়ে অনেক বেশি বড়। শুধু কন্ট্রাক্টর ও বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের দুর্নীতি তদন্ত করলেই চলবে না; যারা কন্ট্রাক্টর ও হাসপাতাল মালিকদের দুর্নীতিতে গা ভাসানোর সুবিধা করে দিয়েছেন, সেসব ব্যক্তির দুর্নীতিরও তদন্ত করতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অপসারণ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার প্রক্রিয়াও চলছে। আমরা কি পারি না দুর্নীতি দমনের জন্য জিম্বাবুয়ের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে?লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর