মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

শিল্প স্থাপনের বড় সমস্যা জমি প্রাপ্তি

স্থাপন হচ্ছে ১০০ অর্থনৈতিক জোন, সংকট সমাধানের স্বপ্ন দেখাচ্ছে বেজা, জমি প্রাপ্তি ব্যাংক ঋণের মর্টগেজসহ কর ও ভ্যাট নীতি আরও সহজ করার দাবি উদ্যোক্তাদের

মানিক মুনতাসির

দেশে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে বড় সংকট কাক্সিক্ষত জমিপ্রাপ্তি। যে কোনো কারখানা স্থাপনের জন্য পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সহজ যোগাযোগ, রাস্তাঘাট- সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নির্ধারিত স্থানে জমি পাওয়া প্রায় দুরূহ ব্যাপার। এ সংকট সমাধানে কাজ করছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনায় সারা দেশে ১০০ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ করছে সরকার। কিন্তু চলতি ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে এসব জোনের মৌলিক অবকাঠামো নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিল্প স্থাপনে জমিপ্রাপ্তির সংকট দিনের পর দিন দীর্ঘায়িত হয়েছে। তবে বেজা কর্তৃপক্ষ বলছেন, খুব শিগগিরই এ সংকট কেটে যাবে। আগামী বছরের শুরুতেই দেশব্যাপী শিল্প বিনিয়োগের এক অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। এসব বিষয়ের অগ্রগতিসহ বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ইকোনমিক জোনগুলোর বাস্তবায়নের সার্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনায় আগামী ২০ আগস্ট পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক ডেকেছে বেজা।

বেজাসূত্র জানান, ২৮টি ইকোনমিক জোনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। আর ৮টি জোনে স্থাপিত শিল্পকারখানা উৎপাদনে রয়েছে। এসব শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, জোনগুলোর কাজ শেষ হলে দেশে শিল্প উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়বে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের রপ্তানি আয় দাঁড়াবে ৫০ বিলিয়ন ডলারে। তবে এর জন্য ইকোনমিক জোনগুলোয় জমি বরাদ্দ পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করার দাবি জানিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের মর্টগেজসহ কর ও ভ্যাট নীতি আরও সহজ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাংক সহজে ব্যবসা করার সূচক প্রকাশ করে। এ সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে তলানিতে। অথচ ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এমনকি ফিলিপিন্সও সূচকে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। এ সূচকের তালিকায় থাকা ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। ভিয়েতনাম ৭০তম। থাইল্যান্ড ২১তম আর মিয়ানমারও বাংলাদেশের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে রয়েছে। যে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী এ দেশে আসতে চাইলে এ সূচকে দৃষ্টি রাখেন। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ চিন্তার শুরুতেই তারা ধাক্কা খান বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)-এর তথ্যমতে এসব জোনে এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রস্তাব। এ ছাড়া চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারতকে দেওয়া হয়েছে পৃথক জোন ও জমি বরাদ্দ। এসব দেশ বরাদ্দ পাওয়া জমি ও জোনে শিল্প স্থাপনে দ্রুত কাজ করছে। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জমি বরাদ্দের ওপর নতুন করে আরোপিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এ ছাড়া সরকারি খাতের বাস্তবায়িত ইকোনমিক জোনগুলোর কাজ চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ফলে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হলেও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে না পারায় কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ আসছে না। এ ছাড়া রয়েছে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা, মসৃণ রাস্তাঘাট ও উন্নত অবকাঠামোর সংকট। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগী দেশ হিসেবে ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, চীন ও থাইল্যান্ড অনেক বেশি এগিয়েছে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে। আর এজন্যই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো শিল্পকারখানা স্থাপন। আর এর জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সেবা। সহজ শর্তে জমিপ্রাপ্তি। এসব বিষয়ে বেজা কাজ করছে। কিন্তু একে আরও বেগবান করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। এফবিসিআইর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি সংস্থা যদি একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় না করে তাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে এসব জায়গায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আরও সমন্বয় প্রয়োজন। অন্যথায় দেশি-বিদেশি কোনো বিনিয়োগই বাড়ানো সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই)-এর সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বাংলাদেশে প্রতিদিনকে বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটা স্থায়ী পলিসি থাকা উচিত। এটা পৃথিবীর অনেক দেশেরই রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে খুব ঘন ঘন পলিসি পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে ভ্যাটনীতি, করপোরেট কর, জমিপ্রাপ্তি, ট্যাক্স হলিডেসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে একটা স্থায়ী পলিসি থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতিযোগী ও প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করপোরেট করহার উচ্চ; যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য এক ধরনের অন্তরায় বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, শিল্প স্থাপনের জমিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে একই বৈষম্য। ভ্যাট ও ট্যাক্স হলিডের ক্ষেত্রে স্থায়ী কোনো নীতিও নেই। প্রায় প্রতি বছরই বাজেটের সময় ভ্যাটসহ এসব নীতির পরিবর্তন হয়; যা বিনিয়োগের অন্যতম বড় বাধা। আমাদের দেশের ভ্যাটনীতি, করপোরেট কর, জমিপ্রাপ্তি, ট্যাক্স হলিডেসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে একটা স্থায়ী পলিসি থাকা প্রয়োজন; যা প্রতিযোগী ও প্রতিবেশী অনেক দেশেই রয়েছে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জমিপ্রাপ্তি-সংক্রান্ত যেসব জটিলতা রয়েছে আমরা তা দূর করার চেষ্টা করছি। আমরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছি।’ নীতি বা কর্মপন্থা সংক্রান্ত কিছু জটিলতা থাকে যেগুলো আরও সহজ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর