মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা
ঢাকা

টিকিটের জন্য হাহাকার ক্ষোভ

মাহবুব মমতাজী

করোনাভাইরাসের প্রভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দুবাই, আবুধাবিসহ মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোয় চালু হয়েছে বিমান। এর পরই মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীদের বিমান টিকিট নিয়ে হাহাকার দেখা দিয়েছে। বিমানের ঢাকা অফিসে টিকিটপ্রত্যাশীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে বিমান অফিসে সকাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের টিকিট পেতে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। টিকিট না পেয়ে বেশির ভাগই বাইরে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। হাতে গোনা কয়েকজন টিকিট পেলেও অধিকাংশ যাত্রীই ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে গতকাল সকাল থেকেই আবুধাবি থেকে ফেরত পাঠানো ৬৮ প্রবাসী বাংলাদেশি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। বিনামূল্যে নতুন টিকিট প্রদান ও কোনো ফ্লাইটে তাদের আবার আবুধাবি পাঠানোর নিশ্চয়তা না দেওয়া পর্যন্ত তারা বিমানবন্দরে থেকে যাবেন না বলেও জানিয়েছেন।

মতিঝিলে বিমান অফিসের সামনে কথা হয় আবদুল কাদের নামে একজন যাত্রীর সঙ্গে। তার বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরায়। গত ৮ এপ্রিল তার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। তিনি সে দেশ থেকে তিন মাসের ছুটিতে জানুয়ারিতে দেশে আসেন। করোনার কারণে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আর যেতে পারেননি। গতকাল বিমান অফিসে টিকিটের জন্য আসেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা তাকে সে দেশে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে বলেন। সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখিয়ে টিকিট নিতে বলেন। তবে তার ওয়ার্কপারমিট এখনো বাতিল হয়নি। তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সিরাজ নামে আরেকজন জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে দুবাইতে থাকেন। তিন মাসের ছুটিতে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর দেশে আসেন। ২৭ মার্চ তার ফিরতি ফ্লাইট ছিল। তার আগেই ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ফ্লাইট চালু হলে দুবাইতে অনলাইনে ফেডারেল অথরিটি ফর আইডেনটিটি অ্যান্ড সিটিজেনশিপ (আইসিএ) আবেদন সম্পন্ন করেন। সবকিছু ঠিকঠাক। এরপর টিকিটের জন্য বিমান অফিসে আসেন। এখান থেকে তাকে বলা হয় যাদের ছয় মাসের মধ্যে টিকিট ছিল তাদের আগে দেবে। যাদের ছয় মাসের বেশি হয়েছে তাদের নেবে পরে। কিন্তু কবে নেবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেনি। অথচ দুবাইতে যোগাযোগ করে জেনেছেন, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। এর আগে তারা ১৩ আগস্ট এসেছিলেন টিকিটের জন্য। ওইদিন বলা হয়েছিল গতকাল আসার জন্য। এদিন আসার পর আবার বলছে দুই মাস অপেক্ষার জন্য। জাহাঙ্গীর আলম নামে আরেক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি ১০ বছর ধরে দুবাই থাকেন। দেড় মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। করোনার জন্য আর ফেরত যেতে পারেননি। তার কোম্পানি থেকে বলা হয় ফ্লাইট চালু হলেই ফেরত যেতে। ১৩ আগস্ট বিমান অফিসে এসে জানতে পারেন কোনো আইসিএ অনুমোদন লাগবে না, শুধু করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ হলেই হবে। ওইদিনই করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিলে টিকিট নিয়ে যান তিনি। গতকাল রাতে তার ফ্লাইট ছিল। সকালে এসে শোনেন, আইসিএ অনুমোদন লাগবে। যে টিকিট তিনি নিয়েছিলেন তা বাতিল করে দিয়েছে।

গত বছরের ১১ অক্টোবর ছুটিতে দেশে আসেন আবদুল মান্নান। তার ফিরতি ফ্লাইট ছিল ২৪ মার্চ। কিন্তু ১৯ মার্চেই বিমান বন্ধ হয়ে যায়। দেশে আসার তার ১০ মাস হয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইসিএ আবেদনে তার ওয়ার্কপারমিটের আইডি নম্বর ও পাসপোর্ট নম্বর দেন। এরপর তাকে এন্টারের (প্রবেশ) অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিমান অফিসে টিকিটের জন্য এলে বলা হয়, ছয় মাস হয়ে গেছে এখন যেতে পারবেন না। যেখানে ওই দেশ যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে, অথচ এরা ছয় মাসের বেশি হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে যেতে দিচ্ছে না! যে কোনো সমস্যার জন্য নোটিস বোর্ডে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করতে বলেন। একাধিকবার ওই নম্বরে কল দিলেও কেউ রিসিভ করেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এ বিষয়ে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট অফিস) শামসুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব অফিসের অভিযোগের বিষয়ে নির্দিষ্ট মুখপাত্র কথা বলবেন। অভিযোগ উঠেছে, যাত্রীরা বিমান অফিসে গিয়ে টিকিট না পেলেও দালালদের মোটা অঙ্কের টাকা দিলে মিলছে টিকিট। কয়েক দিন ধরে ৩৮ হাজার টাকার টিকিট বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাদের অনেকে দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ দামে টিকিট কিনে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। এ সুযোগে একটি সিন্ডিকেট বাড়িয়ে দিচ্ছে টিকিটের দাম। আবুধাবি থেকে ফেরত পাঠানো ৬৮ প্রবাসীর অবস্থান কর্মসূচি পালনের বিষয়ে বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদুল আহসান জানান, প্রবাসীদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিমানের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আশরাফুল আমিন মুকুট এসে তাদের আশ্বস্ত করেছেন, পুনরায় তারা যাওয়ার অনুমতি পেলে টিকিটের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এতেও কোনো কাজ হয়নি বলে জানা গেছে। প্রবাসীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। এ অবস্থানের কারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রবিবার বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমান বা কোনো কর্তৃপক্ষের দোষ নেই। আবুধাবির ইমিগ্রেশন বোর্ডিং ‘ওকে’ করার পরও তাদের প্রবেশের অনুমতি দেয়নি দেশটি। ১০ আগস্টের পর আইসিএ অনুমোদন লাগবে না বলে দেশটি জানালেও পরে আবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে এ জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে ওই প্রবাসীরা আবুধাবি যাওয়ার পর তাদের বিমানবন্দরে নামতে দেওয়া হয়নি। ফলে তাদের হোটেলে রাখতে বাধ্য হয় বিমান। এ ছাড়া এয়ার অ্যারাবিয়া ও এমিরেটসের ফ্লাইটে যাওয়া আরও প্রায় আড়াই শ প্রবাসী একই কারণে সেখানে আটকা পড়েছেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার ফ্লাইটে ২১৪ প্রবাসীকে নিয়ে আবুধাবি থেকে ফেরে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট। এর মধ্যে ৬৮ জন বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো যাত্রী।

ক্যাবের বিবৃতিতে বলা হয়, করোনায় লকডাউন খোলার পর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের কর্মস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হলে পুনরায় ফেরত যেতে বিমানের টিকিট নিয়ে কৃত্রিম সংকট শুরু করে একটি মহল। বাংলাদেশ থেকে বিমানের বিভিন্ন রুটে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বিমান চলা শুরু হয়। বর্ধিত দামে ও রিটার্ন টিকিট কিনেও টিকিট পেতে নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ বিমানের টিকিট বিক্রি নিয়ে নানা অনিয়ম ও অভিযোগ থাকার পরও এসব বন্ধে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি; যার খেসারত দিতে হচ্ছে প্রবাসীদের।

সর্বশেষ খবর