বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর প্রথম রায়

জনি হত্যা মামলায় এসআই জাহিদসহ তিন পুলিশ সদস্যের যাবজ্জীবন, দুই সোর্সের ৭ বছর

আদালত প্রতিবেদক

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর প্রথম রায়

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর মামলায় আসামিরা গতকাল আদালতে

রাজধানীর পল্লবীর বাসিন্দা গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনিকে হত্যার ঘটনায় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে করা মামলার রায়ে পুলিশের তিন সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া মামলায় পুলিশের কথিত দুই সোর্সকে সাত বছর করে কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে এই প্রথম নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে করা কোনো মামলার রায় হলো। আইনটি সাত বছর আগে ২০১৩ সালে পাস হয়।

যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন মাদারীপুরের শিবচর থানার বুয়াতলা গ্রামের মো. ইউনুছ মিয়ার ছেলে পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান, কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার আমলা গ্রামের সুলতান আলীর ছেলে পল্লবী থানার তৎকালীন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল ইসলাম এবং রাজবাড়ী পাংসা থানার বরুরিয়া গ্রামের মো নয়াব আলীর ছেলে পল্লবী থানার তৎকালীন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) কামরুজ্জামান মিন্টু।

অন্য দুই আসামি হলেন পুলিশের কথিত সোর্স রাজধানীর মিরপুর সেকশন-১১, পল্লবীর ব্লক-বি, রহমত ক্যাম্পের কামালের ছেলে আসামি রাসেল ও মিরপুর সেকশন-১১, পল্লবী থানার তিন নম্বর ওয়াপদা বিল্ডিং ক্যাম্পের মোহাম্মদ আলী খোকার ছেলে সুমন। তাদের সাত বছর করে কারাদ- হয়েছে। দ-িত আসামিদের মধ্যে এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু ও রাসেল পলাতক। এ ছাড়া আগে থেকেই কারাগারে আছেন এসআই জাহিদুর রহমান ও সুমন। জামিনে ছিলেন এএসআই রাশেদুল ইসলাম। রায়ের পর রাশেদুলকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘ভিকটিমের তিনজন বন্ধু এ মামলার চাক্ষুষ সাক্ষী। তারা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, নির্যাতনের সময় ভিকটিম পানি চাইলে তার মুখে থুথু ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কেবল আইনের বরখেলাপ নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।’

রায়ে বলা হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পাশাপাশি তিন পুলিশ সদস্যকে এক লাখ টাকা করে অর্থদন্ড, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থদন্ড ছাড়াও নিহতের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই তিন আসামিকে। ক্ষতিপূরণের এই টাকা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে। এ মামলার বাকি দুই আসামি পুলিশের ‘সোর্স’ রাসেল ও সুমনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদন্ডের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান, সেটি আবার প্রমাণিত হলো। এটি দেশে প্রথম নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে করা কোনো মামলার রায়। আর তিন পুলিশ সদস্যকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এ আইনে সেটিই সর্বোচ্চ। আইনটি সাত বছর আগে ২০১৩ সালে পাস হয়।

মামলার বাদী নিহত জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যা মামলায় আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমি ও আমার পরিবার সন্তুষ্ট।’

তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।’

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট নিহত জনির ভাই রকি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে ‘নির্যাতন ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ)’ আইনে মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, ওই বছর ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের ইরানি ক্যাম্পে বিল্লাল নামে এক ব্যক্তির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন জনি। মামলার বাদী রকি নিজেও ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন। পুলিশের সোর্স সুমন মাতাল অবস্থায় ওই অনুষ্ঠানে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করলে জনি তাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেন। তখন ঝগড়ার একপর্যায়ে জনিকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিয়ে চলে যান সুমন। আধা ঘণ্টা পর এসআই জাহিদসহ কয়েকজন পুলিশ এসে ওই অনুষ্ঠান থেকে জনিকে থানায় নিয়ে যান। সেখানে তার ওপর নির্যাতন চলানো হয়। আরও বলা হয়, জনিকে পল্লবী থানার হাজতে নিয়ে এসআই জাহিদসহ অন্য আসামিরা হকিস্টিক, ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে মারধর করেন এবং জনির বুকের ওপর উঠে লাফান। জনি পানি চাইলে জাহিদ তার মুখে থুথু ছিটিয়ে দেন। নির্যাতনে জনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে তাকে ঢাকা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ‘নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে’ আসামিরা পল্লবীর ইরানি ক্যাম্প ও রহমত ক্যাম্পের মধ্যে ‘মারামারির মিথ্যা কাহিনি’ তৈরি করেন। ওই মারামারিতেই রকিসহ কয়েকজনের গুরুতর আহত ও জনি নিহত হওয়ার অভিযোগ এনে এসআই শোভন কুমার সাহা (আসামি) পল্লবী থানায় একটি মামলাও করেছিলেন। পল্লবী থানার তৎকালীন ওসি জিয়াউর রহমান ওই মামলাটিকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে ‘ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নিয়ে যান’ বলে বাদীর মামলায় উল্লেখ করা হয়। পরে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। তদন্ত শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মারুফ হোসেন ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে তিন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুই সোর্সের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়।

রকির করা মামলায় পল্লবী থানার তৎকালীন ওসি জিয়াউর রহমান, এসআই আবদুল বাতেন, রাশেদ, শোভন কুমার সাহা, কনস্টেবল নজরুলকেও আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু বিচার বিভাগীয় তদন্তে তারা অব্যাহতি পান। তদন্তকালে পুলিশের এএসআই রাশেদুল ও কামরুজ্জামান মিন্টুকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজনকে মিরপুর থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন জনি হত্যা মামলার মূল আসামি এসআই জাহিদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর