বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

চাকরির বাজার বন্ধ

শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে । নতুন নিয়োগ নেই । পুরনোরা অনিশ্চয়তায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

চাকরির বাজার বন্ধ

গত দেড় দশকে একটি ভারতীয় কোম্পানি, একটি মাল্টিন্যাশনাল টোব্যাকো কোম্পানি ও একটি বিদেশি ব্যাংকে একের পর এক চাকরি করা আসিফ ইমতিয়াজ জানান, এতদিন এক দিনের জন্যও বেকার থাকতে হয়নি। করপোরেট বাজারে একের পর এক ধাপে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু গত জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে মহামারীর কারণ দেখিয়ে ছাঁটাই করে কোম্পানি। এখন খুব সহসা চাকরির আশাও দেখছেন না। আসিফ বলেন, গত পাঁচ মাস ধরেই চেষ্টা করছি। অনেক বিজ্ঞাপনও পাই। কিন্তু কোথাও মিড লেভেলের বা ম্যানেজারিয়াল লেভেলের কর্মকর্তা নিয়োগ করা হচ্ছে না। ফলে ঢাকা ছেড়ে আসিফ এখন লক্ষ্মীপুরে থাকছেন।

অন্যদিকে মানিকগঞ্জের আরিফুল মালয়েশিয়া যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। বছরখানেক আগে থেকেই যে কোনো মুহূর্তে মালয়েশিয়ার বাজার খোলার কথা শুনে আসছেন তিনি। কিন্তু সেই মালয়েশিয়ার বাজার এখনো বন্ধই আছে। উপায় না পেয়ে ভিসা ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা পান আরিফুল। কিন্তু করোনার কারণে আটকে থাকতে থাকতে মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে এক সময় নতুন ভিসা হয়ে যায় বাতিল।

জানা যায়, বাংলাদেশের চাকরির বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা, ব্যাংক-বীমা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ফলে নতুন চাকরির সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে গেছে। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার কারণে চাকরিচ্যুত করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এতে বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সব ক্ষেত্রে। শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত দুই শ্রেণির চাকরিজীবীরাই বাধ্য হচ্ছেন ঢাকা ছাড়তে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন। সেই সঙ্গে করোনার প্রভাবে বিদেশে কাজ হারিয়ে ফিরেছেন লাখ লাখ মানুষ। তারাও চাকরি খুঁজছেন। সব মিলিয়ে কর্মসংস্থান খাতের অবস্থা খুবই নাজুক। কর্মহীনতার কারণে দারিদ্র্যের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়বে। সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদের মতে, বেকার সমস্যা আমাদের জন্য নতুন কোনো সমস্যা নয়। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। সরকারের উচিত স্বল্পশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত শ্রেণিবিন্যাস করে পৃথকভাবে পরিকল্পনা করা। আর কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যায় শিক্ষিতদের কাজে লাগানো। পাশাপাশি ছোট ছোট ক্লাস্টারে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। তরুণদের উদ্ভাবনী কাজে লাগাতে হবে। যারা ফ্রিল্যান্সিং করেন তাদের আয়ের অর্থ বিদেশ থেকে আনার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। ১০০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচিকে আবার চালু করা যায়। আবার এনজিও ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রতিষ্ঠানও কাজে লাগানো দরকার। ড. নাজনীন বলেন, বেসরকারি খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। কিন্তু করোনার কারণে এই বেসরকারি খাতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এ খাতকে সহায়তা দিয়ে অর্থনীতিটাকে সচল রাখতে হবে।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, দেশের অর্থনীতি ভালো না হলে চাকরির বাজার স্বাভাবিক হবে না। করোনার প্রভাব এখনো যায়নি, কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়নি। নতুন বিনিয়োগ না এলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২৩ শতাংশে আটকে আছে। যত দ্রুত ব্যক্তি খাত ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, তত দ্রুত সংকট কাটবে। তবে ব্যবসা চাঙা না হওয়ায় বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করতে পারছে না। তাই সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নসহ সামাজিক খাতে সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাহলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ড. ফাহমিদা বলেন, সবার কর্মসংস্থান করলেও হবে না। অনেকের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। করোনায় ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ বলেন, সারা দেশের গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে থাকা দেশীয় পণ্যের লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে সরকার সহায়তা দিলে আগামী দিনে কর্মসংস্থান বাড়বে।  কারণ করোনার মধ্যে ই-কমার্সের প্রবৃদ্ধি অনেক হয়েছে। এটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। সারা দেশে যে বেকারত্ব তৈরি হয়েছে, তাদের জীবন বাঁচাতে পারেন গ্রামীণ উদ্যোক্তারা। তাই এখন দরকার যত দ্রুত সম্ভব গ্রামাঞ্চলের উদ্যোক্তাদের পণ্য সরবরাহে সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে যে পরিমাণ ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বের হচ্ছেন, সেই পরিমাণ কর্মক্ষেত্র নেই। ফলে উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে এসএসসি পাস বা এর নিচে থাকা জনগোষ্ঠী শ্রমিক হিসেবে বা কারিগরি বিভিন্ন খাতে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। করোনার আগে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে গড়ে ১২ জন বেকার ছিলেন। এখন তা বেড়ে প্রায় ২৫ জন হয়েছে। এর সঙ্গে আছে পুরনো ২৭ লাখ বেকার। আগস্ট মাসে প্রকাশিত ‘ট্যাকলিং দ্য কভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার স্বল্প মেয়াদি প্রভাবে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হারাতে পারে ১১ লাখ ১৭ হাজার যুব শ্রমশক্তি। যদি ছয় মাসের প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে বেকার হতে পারে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার যুব শ্রমশক্তি। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে শুধু তৈরি পোশাকশিল্পে। এ ছাড়া কৃষি খাত, খুচরা বিক্রেতা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহনসহ সেবা খাতে নিয়োজিত তরুণরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মোট বেকারের প্রায় ৭৬ শতাংশ হতে পারে এসব খাতে। শুধু বাংলাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপাল, পাকিস্তানেরও বেকার দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর