শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে ঢাকার খাল

নিজস্ব প্রতিবেদক

বদলে যাচ্ছে ঢাকার খাল

মিরপুরের একটি খাল আবর্জনামুক্ত করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হয়েছে -রোহেত রাজীব

বাসাবাড়ির বর্জ্য, পলিথিন, প্লাস্টিক আর আবর্জনায় বদ্ধ ছিল রামচন্দ্রপুর খাল। দখলদারদের থাবা ও ময়লার স্তূপে ক্ষীণ হয়ে এসেছিল খালের পানিপ্রবাহ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উচ্ছেদ অভিযান ও পরিচ্ছন্নতায় খালে ফিরছে পানির প্রবাহ। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি) খাল-বক্স কালভার্ট দখলমুক্ত করে পরিষ্কার করছে। দুই সিটি করপোরেশনের জোরদার অভিযানে বদলে যাচ্ছে ঢাকার খাল।

দখলদারদের উচ্ছেদ করে খালে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে উল্লেখ করে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘খালের দায়িত্ব

হাতে পাওয়ার পরই অবৈধ দখল উচ্ছেদে আমরা কাজ শুরু করেছি। যত প্রভাবশালীই হোক, খাল দখলদার কেউ ছাড় পাবে না। খালপাড়ের সব অবৈধ ভবন ভেঙে দেওয়া হবে। মানচিত্র অনুযায়ী খালের জায়গায় যেসব অবৈধ স্থাপনা আছে তা এক তলা বা ১০ তলা যা-ই হোক, ভেঙে ফেলা হবে। এ উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এটা আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করছি।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যেন খালের জায়গায় দখলদারের থাবা না পড়ে এ জন্য খালপাড়ে ওয়াকওয়ে, গাছের সারি ও সাইকেল লেন তৈরি করা হবে। সচল আধুনিক ঢাকা গড়তে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’ খাল পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিদর্শন করে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। স্বল্প মেয়াদের কার্যক্রমগুলো আমরা নিজ অর্থায়নেই শুরু করে দিয়েছি। প্রথম কাজটি হলো খালগুলো দখলমুক্ত করা। বর্ষা মৌসুমের আগেই দক্ষিণ সিটির খাল দখলমুক্ত করতে চাই। খালের বর্জ্যও অপসারণ করব। এর মাধ্যমে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক হলে জলাবদ্ধতা হবে না বলে আমরা আশাবাদী।’ ঢাকায় খালের সংখ্যা কত, এ নিয়েও নানা মত রয়েছে। নদী নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় ৭৩টি খাল রয়েছে। তবে ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৫৮টি। তখন জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এসব খালের মধ্যে ৩৭টিতেই দখলদার রয়েছে। ফলে খালগুলো স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। আর বাকি সব কটি খালের জায়গায় রাস্তা হয়েছে। ডিএনসিসি ২৬টি খাল থেকে বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি দখলদারদের উচ্ছেদ এবং ডিএসসিসি পাঁচটি খাল ও দুটি বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও দখলমুক্ত করার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলছে, ইব্রাহিমপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, গোদাগাড়ী খাল, রূপনগর খাল, সাগুফতা খালসহ ২৬টি খাল থেকে গত দেড় মাসে ৯ হাজার ৩০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান বলেন, ‘ডিএনসিসির আওতাধীন ২৬টি খালে আমরা একযোগে অভিযান পরিচালনা করছি। ভাসমান ময়লা পরিষ্কার প্রায় শেষ। কিন্তু খালের কিছু জায়গা দখল-দূষণে বদ্ধ হয়ে গেছে। সেসব জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে মেশিন দিয়ে খুঁড়ে খালের গভীরতা বাড়াতে হচ্ছে। তাতে কিছুটা সময় লাগছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বর্ষাকে সামনে রেখে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কিছু কাজ করছি। কাজ করছি খাল সংরক্ষণে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, গাছ লাগানো, সাইকেল লেন তৈরির মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েও। সমস্যা একটাই, একদিকে পরিষ্কার করলে অন্যদিকে আবার ময়লা ফেলছে। এ সমস্যা সমাধানে আমরা বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করে কাজ করছি।’ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২ জানুয়ারি থেকে দক্ষিণ সিটির জিরানী, শ্যামপুর ও মান্ডা খাল এবং সেগুনবাগিচা ও পান্থপথ বক্স কালভার্টে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করছে। খাল ও বক্স কালভার্ট থেকে ১ লাখ ৬ হাজার টন পলি মাটি ও ২৬ হাজার ৯২০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন বলেন, ‘ওয়াসার কাছ থেকে খাল ও বক্স কালভার্ট বুঝে পাওয়ার পর থেকে আমরা তিনটি খাল ও দুটি বক্স কালভার্ট পরিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি। নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পুরোদমে আমাদের এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’ আগে ঢাকার ২৬টি খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছে ছিল। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর এসব খালের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনে হস্তান্তর করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে খাল ও নালা পরিষ্কার এবং দখলমুক্ত করতে টানা অভিযান পরিচালনা করছে দুই সিটি করপোরেশন। দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, খাল দখলমুক্ত ও বর্জ্য অপসারণের কাজে গত দেড় মাসে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত নিজস্ব তহবিল থেকে এ টাকা খরচ করেছে দুই সিটি। খাল ও নালার রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের কাছে ২৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে উত্তর সিটি প্রাথমিকভাবে চেয়েছে ৬১ কোটি টাকা। আগে খাল রক্ষণাবেক্ষণে ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব কোনো বরাদ্দ ছিল না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এ খাতে বছরে ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকা পেত ওয়াসা। নগর-বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, খালের চারপাশে ওয়াকওয়ে করে গাছ লাগিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে দিতে হবে, যাতে পুনরায় দখল না হয়। বেশি জায়গা থাকলে বসার জায়গা, সাইকেল লেন, এমনকি জরুরি ক্ষেত্রে স্ট্রেচার কিংবা অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। তবে খাল পরিচ্ছন্ন রাখতে সবচেয়ে জরুরি পুনরায় ময়লা না ফেলা। এ জন্য এলাকাবাসীকে নিজ নিজ বাড়ির সামনের খালের দেখাশোনার দায়িত্ব দিতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করলে খাল পুনরায় বর্জ্যরে ভাগাড় হবে না।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর