মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান

মাহে রমজানুল মোবারকের আজ সপ্তম দিবস। আল্লাহতায়ালা এ মাসের রোজা প্রত্যেক সক্ষম মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ করেছেন। তবে এ থেকে সাময়িকভাবে হলেও ছাড় দেওয়া হয়েছে রোগী ও মুসাফিরকে। অসুস্থতা যেমন সিয়াম পালন থেকে ছাড় পাওয়ার একটি কারণ, তেমনি আরেক কারণ সফর। এ প্রসঙ্গে  কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, তাকে রোজা রাখতে হবে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ কিংবা সফরে থাকে সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, কঠিন করতে চান না। নিশ্চয় তিনি পরম দয়াময় করুণার আধার।’ সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫।

তবে সালাত ও সিয়ামে ছাড় পাওয়ার জন্য সফরের দূরত্ব ও মেয়াদ বিবেচ্য বিষয়। নামমাত্র ভ্রমণ ও প্রবাসজীবনকে যেন ইবাদতে বিশেষ সুবিধা লাভের কারণ হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে না চায়, সে জন্য এসব শর্ত নির্ধারণ করেছেন ফকিহরা। উল্লেখযোগ্য দূরত্ব একটি শর্ত হিসেবে গণ্য। হেঁটে স্বাভাবিক গতিতে তিন দিনে যে পরিমাণ পথ অতিক্রম করার রীতি তখনকার আরবে প্রচলিত ছিল, সেটাকে এ ব্যাপারে বিবেচনায় নিয়েছেন ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.)। এই তিন দিনের পথ বা তিন মঞ্জিল আজকের আধুনিক পরিমাপে ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার হয়েছে। তাছাড়া কোরআন মজিদের ‘আলা সফর’ শব্দ থেকে অনুমিত হয়, নিছক প্রবাসজীবন নয়, বরং চলমান অবস্থা শর্ত। তাই সফরকালে উল্লেখযোগ্য সময় বা কমপক্ষে ১৫ দিন যাত্রাবিরতির কারণে সালাতে কসর ও সিয়ামে ছাড়ের হুকুম রহিত হয়ে যায়। সফর ক্লান্তিকর হওয়াই স্বাভাবিক। জাগতিক ক্রিয়াকলাপের প্রয়োজনে মানুষকে সফরে যেতেই হয়। তাই ইসলামী শরিয়তে মুমিন বান্দাদের জন্য সফরকালে সালাত ও সিয়াম আদায়ে ছাড় দেওয়া হয়েছে। যদি কারও সফর ব্যতিক্রমী হিসেবে আরামদায়ক হয়ও, তবুও তার জন্য এ সুবিধা রহিত হবে না। একজন তাবেয়ি এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন হজরত ওমর ফারুক (রা.) কে। জবাবে হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, তুমি যেমন আমাকে প্রশ্ন করেছ, আমিও তেমনি আল্লাহর রসুল (সা.) কে এ প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম, হে আল্লাহর রসুল, আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা সফরে থাকবে, তখন তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে কাফেররা তোমাদের বিপদে ফেলবে, তাহলে নামাজে কসর করায় তোমাদের কোনো অন্যায় হবে না’, এখন তো আমরা নিরাপদ হয়ে গেছি। জবাবে মহানবী (সা.) বলেন, এটা আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ। এ অনুগ্রহ তোমরা গ্রহণ করো। এ জন্য ইমাম আবু হানিফার মতে, সফরে নামাজের কসর করা বাধ্যতামূলক। অবশ্য অন্য ইমামরা একে ঐচ্ছিক বলেছেন। কিন্তু সফরে রোজা রাখা না রাখা দুটিরই অনুমতি আছে, এ ব্যাপারে সব ইমাম একমত।

সফরে রোজা রাখা নাকি না রাখা- কোনটি ভালো, এ সম্পর্কে দুই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। এক হাদিসে দেখা যায়, আল্লাহর রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সফরে রোজা রাখা খুব ভালো।’ কিন্তু আরেক হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, ‘সফরে রোজা রাখা নেক কাজ নয়।’ মহানবী (সা.) এর অন্য একটি উক্তির প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যায়। তা হলো- এক সফরে রসুলুল্লাহ (সা.) এক জায়গায় লোকজনের ভিড় দেখে জানতে চাইলেন, কী হয়েছে, এত ভিড় জমিয়েছ কেন? সেখানে তখন একজনকে ছায়ায় রেখে সেবা করা হচ্ছিল। সাহাবিরা জানালেন, লোকটি রোজা রাখার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তখন রসুল (সা.) বললেন, ‘সফরে রোজা রাখা নেক কাজ নয়।’

আরেক সফরে সাহাবায়ে কেরামের কেউ কেউ রোজা রাখলেন, আবার কেউ কেউ রোজা রাখলেন না। এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলে রোজাদাররা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। আর যারা রোজা রাখেননি, তারাই তাঁবু টানানো, বাহনগুলো সামলানো ইত্যাদি সব কাজ করলেন। তখন মহানবী (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘বেরোজাদারেরা সব পুণ্য হাসিল করল।’

রমজান মাসেই সংঘটিত হয়েছে ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ বদর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেন, ‘আমরা রোজা রেখেই রওনা হয়েছিলাম। চলতে চলতে যখন শত্রু বাহিনীর একেবারে কাছে পৌঁছলাম, তখন আল্লাহর রসুল আমাদেরকে রোজা না রাখার আদেশ দিলেন।’ তিনি নিজেও রোজা ভেঙে ফেললেন। অন্য আরেকটি যুদ্ধ প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আমরা রোজা রেখেই রওনা হলাম। কয়েক দিনের সফর শেষে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অবসন্ন হয়ে পড়ল। এ খবর আল্লাহর রসুলের কাছে গেলে তিনি রোজা ভেঙে ফেললেন এবং সবাইকে রোজা ভেঙে ফেলার আদেশ করলেন। এর পরও কেউ কেউ দিনটি শেষ করতে চাইলেন। মহানবী (সা.) এতে অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। মোটকথা সফরে রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে যদি কারও কষ্ট না হয়, তাহলে রোজা রাখা ভালো। আর যদি রোজা রাখার কারণে বেশি কষ্ট হয়, এমন কি সফরের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে না রাখাই ভালো। পরে এই রোজাগুলো আদায় করতে হবে। কিন্তু রোজা না রাখার অনুমতি থাকলেও রমজান মাসের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। এ জন্য প্রকাশ্যে পানাহার করা চলবে না, বরং তা আড়ালে সারতে হবে। ঠিক এই হুকুম কোনো কারণে রোজা নষ্ট হয়ে গেলেও। সে ক্ষেত্রেও দিনের বাকি সময়টুকু রোজাদারের মতোই কাটাতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।

www.selimazadi.com

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর