রবিবার, ৩০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

অর্থ জোগানের চাপ থাকবে সারা বছরই

মানিক মুনতাসির

অর্থ জোগানের চাপ থাকবে সারা বছরই

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়টাই বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অর্থায়নের চাপ থাকবে সরকারের ভিতরে। এই চাপ সামলাতে ও সংকট মেটাতে বৈদেশিক উৎসে নির্ভরতা বাড়াতে চায় সরকার। তবে অভ্যন্তরীণ হিসেবে দেশের ব্যাংক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য উৎসের ওপরও চাপ থাকবে। যদিও সরকার আশা করছে আগামী বছর রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ পাওয়া যাব, যা দিয়ে বাজেটের ঘাটতি মেটানো হবে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশের অনুকূলে ৩৩৫ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় করেছেন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো, যা বাংলাদেশ মুুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ২৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার বেশি। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী অর্থবছরের নেওয়া সর্বোচ্চ বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ পাওয়ার পরিকল্পনা বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ঘাটতির অর্থায়নে মার্চ-২০২১ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি (জুলাই-মার্চ) দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত দুই লাখ ২৭ হাজার ৭৬৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮০৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৯৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকায়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে মানুষের আয় কমেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাজ করছে মন্দা পরিস্থিতি। সে কারণে নতুন করের বোঝা চাপিয়ে জনগণের ওপর চাপ বাড়াতে চায় না সরকার। তবে করযোগ্য অথচ কর দিচ্ছেন না এমন লোকেদের করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর অতি সম্পদশালীদের সম্পদে অতিরিক্ত হারে সারচার্জ বসিয়ে আয় বাড়াতে চায় সরকার।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, আসছে বাজটের খসড়া রূপরেখা অনুযায়ী মোট রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। আসছে বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা, যা হবে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাজেট ঘাটতি। গত এক দশক ধরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই ছিল। এবার তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বছর শেষে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার ধরা হচ্ছে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ওই বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। মূল বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের বিপরীতে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল ৬৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ওই বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের জিডিপির ৫ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অর্থবছরটিতে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের জিডিপির ৫ শতাংশ। ২০১১-১২ বাজেটে ঘাটতি ছিল ৪০ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। ২০১০-১১ বাজেটে ঘাটতি ছিল ৩৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ১২ বছরে বাজেট ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৪ কোটি টাকা। অবশ্য এ সময়ে বাজেটও বেড়েছে প্রায় ৪ লাখ ৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি সত্ত্বেও সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন সক্ষমতাও বেড়েছে, যা বাজেট ঘাটতির চাপ সামলানোকে টেকসই করেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজেট ঘাটতি প্রতি বছরই থাকে। কারণ আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও অনেক কম। যার ফলে রাজস্ব আদায় কম হয়। গত বছর শেষে শুরু হওয়া করোনা মহামারীর কারণে সরকারের আয় কমে গেছে। রাজস্ব আদায়ে ছন্দ পতন ঘটেছে। ফলে আগামী বছর যদি বাজেট ঘাটতি আরও বেশি হয় সেটা অস্বাভাবিক কিছু হবে না। যার ফলে বাজেট অর্থায়নে সরকারের ওপর বরাবরের মতো চাপ থাকবে। এই চাপ সামলাতে সরকার দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেবে। তবে এই ঘাটতি মেটাতে সরকার যে কাজ করবে সেটা যদি এমন হয় যে, ব্যাংক খাত থেকে অনেক বেশি ঋণ নেয় তাহলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না। এমনিতেই করোনার কারণে আমাদের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত নির্ভরতা কমাতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

অর্থায়নের সংকট মোকাবিলায় আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর ব্যাংক খাত থেকে ৭৬ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা করছে সরকার, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এই হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ কম। ব্যাংক ছাড়াও অন্যান্য উৎস থেকে ৩৭ হাজার কোটি টাকা আহরণ করবে সরকার, যা চলতি বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। আর বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা হিসেবে ৯৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বাজেট ঘাটতির অর্থ জোগান দিতে সরকার ব্যাংকিং খাতের ঋণনির্ভরতা কমিয়ে বিদেশি উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে কাজ করছে। এ জন্য নতুন বাজেটে বৈদেশিক অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় এই হার ৩৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। চলতি বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা হিসেবে ৯২ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অবশ্য করোনা মহামারীর এই সময়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ বেড়েছে। আসছে বাজেটেও বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা হয়েছে, যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাতেও উল্লেখ থাকবে বলে জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে প্রায় ৫০ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক অনুদান পাইপলাইনে রয়েছে। এ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা মহামারীর মধ্যে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর