শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

হস্তশিল্পের বাজিমাত ৫০ দেশে

করোনাকালে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ, প্রধান বাজার উত্তর আমেরিকা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য, দেশি বাজার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার

রুহুল আমিন রাসেল

হস্তশিল্পের বাজিমাত ৫০ দেশে

বিশ্বের ৫০ দেশে বাংলাদেশি হস্তশিল্প পণ্যের বিকিকিনি চলছে। বৈশ্বিক জায়ান্ট ওয়ালমার্টসহ বৃহৎ ক্রেতাদের দৃষ্টি এখন হস্তশিল্পে। করোনাকালে অন্যান্য খাত যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন হস্ত্রশিল্পের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ, যার প্রধান বাজার উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। এই পণ্যের দেশীয় বাজার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, আগামী ২০২৩ সালে হস্তশিল্পের বৈশ্বিক বাজারের আকার হতে পারে ৫২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকার মুখে দাম কমিয়েছে ক্রেতারা। দেশে কমেছে নগদ সহায়তা। তবুও সংকট কাটাতে উদ্যোক্তারা মনে করেন কর কমিয়ে নগদ প্রণোদনা বৃদ্ধি ও থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত, চীনের আদলে সরকারি সহায়তায় কারুপল্লী প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ প্রসঙ্গে হস্তশিল্প উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি বা বাংলাক্রাফটের সভাপতি গোলাম আহসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের চেয়ে বিদেশে চাহিদা বেশি বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের ক্রেতারা হাতে তৈরি পণ্য এখন বেশি পছন্দ করেন। এই বৈশ্বিক চাহিদা কাজে লাগিয়ে দেশে কারুপল্লী গড়ে তুলতে সরকারি ঋণ সহায়তা প্রয়োজন। আমরা সরকারের কাছে নামমাত্র সুদে ঋণ চাই। এর আগে হস্তশিল্প খাতে রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা আগের মতো ২০ শতাংশ ও রপ্তানি ভর্তুকির ওপর উৎসে কর আগের মতোই ৩ শতাংশ বহাল রাখার দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে গত ১৫ জুন পৃথক পৃথক চিঠি দিয়েছে বাংলাক্রাফট। অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইকে দেওয়া চিঠিতে বাংলাক্রাফট বলেছে- প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য হস্তশিল্পে নগদ সহায়তা বিশাল অবদান রাখে। হস্তশিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা জড়িত। হস্তশিল্পজাত পণ্য সম্পূর্ণভাবে দেশীয় কাঁচামাল থেকে উৎপন্ন হয়।  এসব কাঁচামাল গ্রামীণ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এসব পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। হস্তশিল্পজাত পণ্য প্রায় শতভাগ মূল্য সংযোজন হয়। ফলে আমদানিনির্ভর রপ্তানি পণ্যের তুলনায় অর্থনীতিতে বেশি অবদান রাখছে। তাই নীতি সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে রপ্তানি নীতি ২০১৮-১৯ এ হস্তশিল্প পণ্যকে বিশেষ উন্নয়নমূলক খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গ্রামীণ পর্যায়ে এ খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, ইতিমধ্যে হস্তশিল্পজাত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তার হার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে হস্তশিল্প মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় রপ্তানি ভর্তুকির ওপর উৎসে কর কর্তনের হার ৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা হলে হস্তশিল্প রপ্তানিকারকদের কোনোভাবেই এই ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে না। তাই উৎসে কর হার ৩ শতাংশ বহাল রাখা হোক। আরেকটি চিঠিতে বাংলাক্রাফট বলেছে- করোনা মহামারীর প্রভাবে বাংলাদেশের হস্তশিল্প খাত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দের কথাও আছে। করোনার প্রভাবে বিশ্ববাজারে অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি আয় কমলেও, হস্তশিল্প পরিবেশবান্ধব হওয়ায় রপ্তানি বাজার বেড়েছে। বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়লেও করোনাকালে ক্রেতারা অনেক দাম কমিয়েছেন। করোনার আগে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লাভ হলেও, এখন মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় বাজারে কয়েক বছর ধরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে হস্তশিল্পের বাজার সম্প্রসারিত হলেও, করোনাকালে তা ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হলেও, হস্তশিল্পে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। এর ওপর উৎসে কর কেটে রাখার পর উদ্যোক্তাদের থাকছে মাত্র ৮ শতাংশ। এতে হস্তশিল্পের রপ্তানিকারকরা ব্যাপক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। এখন নগদ সহায়তার হার বাড়ানো হলে, রপ্তানির পরিমাণ অনেক বাড়বে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বিশ্ববাজারে হাতে তৈরি পণ্যের দামের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয়। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হস্তশিল্পজাত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তার পরিমাণ আগের মতোই ২০ শতাংশ বহাল রাখা জরুরি বলে মনে করছে বাংলাক্রাফট। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির তথ্য বলছে- চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি এই ৭ মাসে হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৯৬ লাখ ১০ হাজার ডলার। যা আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ১ কোটি ৩২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়- গত বছরের তুলনায় এ আয়ের পরিমাণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৯-২০ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানি আয় যথাক্রমে ২ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার ডলার এবং ১ কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার। বাংলাক্রাফটের তথ্য বলছে- বাংলাদেশ থেকে হস্তশিল্পজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, স্পেন, জাপানসহ বিশ্বের ৫০ দেশে রপ্তানি হয়। করোনার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোর চীন বিমুখতা ও ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ায় বাংলাদেশি হস্তশিল্পের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ইউরোপেই ৬০ শতাংশ হস্তশিল্প রপ্তানির হয়। রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে- হাতে বোনা কাপড় ও কার্পেট, ঘর সাজানোর পণ্য, টেরাকোটা এবং মাটির পাত্র। আরও আছে পাটের তৈরি পণ্য, হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকারের ঝুড়ি, বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের বাস্কেট, ফ্লোর কাভারিংয়ের ম্যাট বা কার্পেট, নকশিকাঁথা ও নকশি বেডশিট ইত্যাদি।

সর্বশেষ খবর