বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

খোলার অপেক্ষায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা । প্রস্তুত মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলার ঘোষণা । দ্রুত চায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো । শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠক আজ

মাহমুদ আজহার ও আকতারুজ্জামান

দীর্ঘ প্রায় দেড় বছরের ছুটিতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে ৪ কোটি শিক্ষার্থী। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সংক্রমণের হার কিছুটা নিম্নগতি থাকায় সরকারও ইতিবাচক। এরই মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে সারা দেশের প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও জানিয়েছেন, তারাও দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে চান। এখন সরকারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়সূত্র জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে আজ বৈঠক ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভার্চুয়াল মাধ্যমে এ বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছাড়াও ইউজিসি চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নগামী হচ্ছে। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেওয়া আছে। এর মধ্যেই দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। সব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম চালু থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠান খোলার যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এদিকে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। রাজধানীর বাইরে যেসব এলাকায় সংক্রমণের হার শতকরা ৫ ভাগের কম সেসব এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়ার পাশাপাশি অনলাইনেও শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সরকার যেভাবে এগোচ্ছে তা ঠিকই আছে। তবে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পাশাপাশি যেসব এলাকায় সংক্রমণের হার শতকরা ৫ ভাগের কম সেসব এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। জাতীয়ভাবে এখনই ৫ ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ঢাকা বিভাগ বা রাজধানীতে সংক্রমণের সংখ্যা সব সময় একটু বেশি। তাই শিক্ষাকে এখন বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। করোনা সংক্রমণ কবে শেষ হবে তা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছেন না। অনলাইনে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। ক্লাসে প্রযুক্তি শিক্ষা বাড়াতে হবে।’ ২১ আগস্ট প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়- সাত দিনের মধ্যে প্রধান শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষ, শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয় ভবন, ওয়াশব্লক, আসবাবপত্র, টিউবওয়েল, খেলার মাঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিদ্যালয় পাঠদানের উপযোগী করে প্রস্তুত রাখবেন। সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছে এ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।

প্রভোস্ট কমিটির সুপারিশের পর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম ধাপে অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের পরীক্ষা শেষ হলে নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে অনার্স প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে ওঠানো হবে। প্রভোস্ট কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে গতকাল নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডিন্স কমিটির বিশেষ সভায় এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বর্ষের স্থগিত পরীক্ষা সেপ্টেম্বর থেকে সশরীরে নেওয়ার তারিখ ঘোষণা দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ নিম্নগামী হচ্ছে। আগামী মাসে এটি ১০ শতাংশের নিচে নামার সম্ভাবনা রয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলো খুলে দেওয়া যাবে বলে আমি আশাবাদী। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অক্টোবরে খুলে দিয়ে ক্লাস শুরু করা যাবে বলে আমি মনে করি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবাসিক হল নেই। তাই সেগুলোও খুলে দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষক করোনার টিকা নিয়েছেন। এ ছাড়া ৩৫ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টিকা নেওয়ার তথ্য পেয়েছে ইউজিসি।’ প্রসঙ্গত, দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।

জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের পর্যায় থেকে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা ও সংক্রমণ পরিস্থিতি ‘সন্তোষজনক অবস্থায়’ নেমে এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়ে আসছে সরকার। কভিড-১৯-এর কারণে যেসব দেশে দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটি গতকাল তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, মহামারীতে লম্বা সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চাই আমরা। এ ব্যাপারে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এখন সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। নির্দেশনা পেলেই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে।’ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা চাই দ্রুত স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক। তাই দ্রুতই একটি রোডম্যাপ করে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেব।’ করোনার শুরু থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অনলাইনে পাঠদানে শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। বেসরকারি শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ দাবি করা হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিয়ে সরকার-অভিভাবক উদ্বিগ্ন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এও ঠিক এখন সবকিছুই খোলা। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আপাতত সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া উচিত। সপ্তাহের সব দিন না খুলে দুই-এক দিন করে খুলে দেওয়া যেতে পারে। একইভাবে পরীক্ষাও সীমিত পরিসরে নেওয়া যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পাশাপাশি অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা সব সময়ই চালু রাখতে হবে। এটা বন্ধ করা উচিত হবে না। করোনার পাশাপাশি জীবন-জীবিকার যুদ্ধে জয়ী হতে উচ্চশিক্ষা প্রসারের কোনো বিকল্প নেই বলেও আমি মনে করি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর