শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মরিশাসে বাংলাদেশি তরুণীকে বর্বর নিপীড়নের ভয়াবহ কাহিনি

আলাউদ্দিন আরিফ

অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর আশায় নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া এলাকার কামাল মিয়া (ছদ্মনাম) তার বন্ধুর মাধ্যমে মরিশাস যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি রাজধানীর রামপুরা এলাকার মেসার্স গোলাম রাব্বী ইন্টারন্যাশনালে (আর.এল.১০৭৮) কিছু টাকা ও পাসপোর্ট জমা দেন। বেশ কিছুদিন তাকে ঘোরানোর পরও তিনি মরিশাস যেতে পারেননি। এক পর্যায়ে কামালের মেয়ে শান্তাকে (ছদ্মনাম) মাত্র ৯০ হাজার টাকায় মাসে ২৮ হাজার টাকা বেতনে মরিশাস নেওয়ার প্রস্তাব দেন ট্রাভেল এজেন্সির মালিক আক্তার হোসেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে টাকা কম ও ভালো বেতন দেখে রাজি হয় কামালের পরিবার। মরিশাস যাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও দালাল শাহ আলমের সহযোগিতায় মরিশাসে ফায়ারমাউন্ট টেক্সটাইল নামক তৈরি পোশাক কারখানার মালিক অনিল কোহলি কৌশলে শান্তাকে অচেতন করে শ্লীলতাহানি করে। যার ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেল করে দফায় দফায় ধর্ষণ করায় শান্তা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। অবৈধ ক্লিনিকে নিয়ে তার গর্ভপাত করানো হয়। দালাল শাহ আলম তার নিজ বাসায় নিয়ে শান্তাকে দিনের পর দিন নির্যাতন ও ধর্ষণ করে। আরও ধর্ষণ করে তার দুই ভাগ্নে। এক পর্যায়ে শান্তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় অনিল কোহলির বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ সেক্স করার। এভাবে প্রায় এক বছর নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসেন শান্তা। দেশে আসার আগে শাহ আলম ও অনিল কোহলি কৌশলে শান্তার বাবাকে নিয়ে যান মরিশাসে। কামালকে সেখানে জিম্মি করে ভয়াবহ নির্যাতন করে আবার শান্তাকে সেখানে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তারা। শান্তা যাতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নেয় সেজন্য হুমকি-ধমকি ছাড়াও তার বাবার ওপরও চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। শান্তা ও তার বাবার ওপর ভয়ানক নির্যাতনের কাহিনি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে নিজেই বর্ণনা করেন শান্তা। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। আমরা দুই বোন এক ভাই। আমার ভাই বয়সে খুবই ছোট। বাবার বয়স প্রায় ৫৪। আমি মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর অর্থের অভাবে আর পড়া হয়নি। বাবা মরিশাস যাওয়ার জন্য রামপুরার গোলাম রাব্বী ইন্টারন্যাশনালে ২০১৮ সালে পাসপোর্ট ও টাকা জমা দেন। দীর্ঘদিন পাসপোর্ট আটকে রেখেও তারা বাবাকে মরিশাস নিতে পারেনি। একদিন এজেন্সির মালিক আক্তার হোসেন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আমাদের বাসায় যায় এবং আমাকে দেখে। পরে আমার বাবাকে বলে আপনার মেয়েটা উপযুক্ত এবং কর্মক্ষম। কম খরচে গার্মেন্টে মেশিন অপারেটরের ভিসায় মরিশাস পাঠানো যাবে। আরও অনেক মেয়ে বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাচ্ছে। আমার বাবা শুরুতে রাজি হননি। পরে আমি ভাবলাম অভাবের সংসারে আমি গার্মেন্টে কাজ করে যদি একটু সচ্ছলতা ফেরাতে পারি। তাদের প্রস্তাব মতো আমি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে মাসে ২৮ হাজার টাকা বেতনে মরিশাস যাই। যাওয়ার আগে মেসার্স আক্তার অ্যান্ড সন্স নামে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মাধ্যমে ছাড়পত্র নেওয়া হয়। ওই গ্রুপে আমার সঙ্গে ২৬ জন বাংলাদেশি নারী ছিল। যাদের মধ্যে আমি ছাড়া সবাই ছিল বিবাহিত। আমরা মরিশাস যাওয়ার পর ফায়ারমাউন্ট টেক্সটাইল কোম্পানিতে আমাকে হেলপার হিসেবে কাজ দেওয়া হয়। ফায়ারমাউন্ট টেক্সটাইল কারখানার কর্মচারীদের ক্যান্টিন পরিচালনা করত ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার চম্পাকনগর গ্রামের তাজুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ শাহ আলম। তার সহযোগী ও ভাগ্নে পরিচয় দিত ফোরকান, সিদ্দিক ও আসলাম। কাজ শুরুর কয়েক দিন পর ক্যান্টিনের বাবুর্চি আসলাম আমাকে বলে, ‘কারখানার বস তোমাকে দেখেছেন এবং পছন্দ করেছেন।’ আমি শুরুতে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। এক পর্যায়ে শাহ আলম আমাকে বসের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক করার প্রস্তাব দেয়। আমি রাজি হইনি। এই অবস্থায় কারখানার পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত মালিক অনিল কোহলি আমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আমার সঙ্গে কথা বলেন এবং তার বাসায় যেতে বলেন। অনিল যুক্তরাজ্য ও মরিশাসেরও নাগরিক। আমি তার কুপ্রস্তাবে রাজি হইনি। এই অবস্থায় কারখানা ও ক্যান্টিনের কর্মচারীরা আমাকে এড়িয়ে চলতে থাকে। আমার কাজে নানাভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। অযথা বকাঝকা, সবার সামনে অপমান করা, শুধু শুধু ভুল ধরা নানাভাবে আমাকে হেনস্থা করতে থাকে। আমার সহকর্মীরা পরামর্শ দেয় শাহ আলম বসের ‘ডানহাত’; তার সঙ্গে কথা বলো। আমি বিষয়টি শাহ আলমকে জানালে সে বলে, ‘তোমাকে আগেই বলেছি তুমি বসের কাছে যাও, এটা বস ছাড়া কেউ সমাধান দিতে পারবে না। তিনি তোমার অমতে কিছু করবেন না।’ গত বছরের এপ্রিল মাসের ২৯ বা ৩০ তারিখ বিকাল ৫টার দিকে শাহ আলম আমাকে বসের বাসায় নিয়ে যায়। গিয়ে দেখি তার হাতে মদের গ্লাসের মতো কিছু একটা। তিনি শাহ আলমের সঙ্গে আমাকে দেখেই হিন্দি ভাষায় বিভিন্ন প্রশংসা শুরু করেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘দেখো আমার এখানে তোমার চাইতে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে। দেখতে চাইলে আমার রুমে যাও।’ কথা বলার সময় আমার হাত থেকে আমার মোবাইল ফোন ফ্লোরে পড়ে যায়। আমি মোবাইল তুলতে গেলে বস অনিল কোহলি (৬৫) হঠাৎ আমাকে হাতের ছিনায় ধরে টেনে হিঁচড়ে একটি রুমে নিয়ে যায়। সেখানে কেউ না থাকায় আমি বলি স্যার এখানে তো কেউ নাই। এ সময় অনিল কোহলি হঠাৎ করে আমার মুখে জেল জাতীয় কিছু একটা মেখে দেয়। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসে, মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। এই অবস্থায় অনিল কোহলি আমাকে তার খাটে শুইয়ে দেয়। আমি অচেতন হয়ে পড়ি। প্রায় চার ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার চোখে মুখে পানি চিটিয়ে আমার জ্ঞান ফেরানো হয়। তখন আমি কাপড় খোলা দেখি এবং আমার শরীরের নিচের অংশে প্রচ- ব্যথা অনুভব করি। আমি বুঝতে পারি আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমি কান্নাকাটি করতে থাকি। অনিল কোহলি কিছুক্ষণ পর শাহ আলমকে ডেকে এনে আমাকে মেসে পৌঁছে দিতে বলে। শাহ আলম তার গাড়িতে করে আমাকে মেসে পৌঁছে দেয়। ২-৩ দিন পর আবার আমাকে ডেকে নেওয়া হয় অনিল কোহলির বাসায়। সেখানে আবার আমাকে ধর্ষণ করা হয়। এভাবে সপ্তাহে দুই দিনবার চলতে থাকে। প্রায় দুই মাস পর গত বছরের মে মাসের দিকে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। খাওয়া-দাওয়া করতে পারি না, সব কিছুতেই গন্ধ লাগে। শাহ আলমকে বিষয়টি জানালে সে মরিশাসের একজন নারীর সহযোগিতায় আমাকে কারখানার বাইরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসক আলট্রাসনোগ্রাম করে জানায়, আমি ৫ সপ্তাহের গর্ভবতী। পরে শাহ আলম আমার অমতে গোপন একটি ক্লিনিকে নিয়ে অবৈধভাবে আমার গর্ভপাত করায়। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহ আলম আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর শুরু হয় নতুন অত্যাচার। বাসার কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা থেকে শুরু করে সব কাজ অসুস্থ শরীর নিয়েই করতে হতো। অসুস্থ থাকা অবস্থায় শাহ আলমের ভাগ্নে ফোরকান ও সিদ্দিক আমার শ্লীলতাহানি করে। আমি শাহ আলমকে বিষয়টি জানালে সে উল্টা বলে ‘এটা বসের জিনিস। বস এক জিনিসে বেশিদিন খুশি থাকে না। বস ছেড়ে দিলে তোদের হবে।’ শাহ আলমের বাসায় থাকা অবস্থায় একদিন সে হঠাৎ করে ফোরকান ও সিদ্দিককে বলে ‘তোরা এখন থেকে গোডাউনে ঘুমাবি। শান্তা আমার সঙ্গে থাকবে।’ এরপর থেকে শাহ আলম আমাকে প্রতি রাতেই ধর্ষণ করত। এভাবে কয়েকজনের ধর্ষণের শিকার হয়ে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি কারখানায় কাজেও যেতে পারি না। বেতন না পাওয়ায় বাড়িতেও টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে অনিল কোহলি তার কয়েক বন্ধুর সঙ্গে গ্রুপ সেক্স করার প্রস্তাব দেয় এবং বলে ওই গ্রুপে আরও কয়েকজন মেয়ে থাকবে। আমি তাদের বর্বর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে শাহ আলমের হাতে পায়ে ধরে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ করি। আমি অসুস্থ থাকায় তখন তারা শর্ত দেয় যে, ‘আমার বাবাকে মরিশাস নিয়ে গেলে আমাকে আসতে দিবে। আমি শুরুতে রাজি হইনি। পরে তাদের উপর্যুপরি অত্যাচার নির্যাতন সইতে না পেরে বাবাকে মরিশাস নিয়ে যাই। তারা এক দিনও বাবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়নি। আমার বাবাকে জিম্মি করে আটকে রাখে; যাতে আমি আইনগত ব্যবস্থা না নিতে পারি।

শান্তা বলেন, ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর আমি বাংলাদেশে আসি। আসার পর আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। একপর্যায়ে রাজধানীর দক্ষিণখানের বাসায় সিলিং ফ্যানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। এই অবস্থায় আমার বড়বোন বিষয়টি দেখে ফেলে। তিনি জানতে চাইলে আমি তার কাছে পুরো বিষয়টি খুলে বলি। তিনি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা জানান, আমার জরায়ুতে টিউমার জাতীয় কিছু একটা হয়েছে যা শিগগিরই চিকিৎসা না করালে ক্যান্সারে রূপ নেবে। আমার বোন বেসরকরি সংস্থা ব্র্যাকে চাকরি করে। তিনি ব্র্যাকের একজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘ চিকিৎসায় আমি সুস্থ হই। এর মধ্যেও শাহ আলম ও অনিল গংরা আমার বাবাকে জিম্মি করে আমাকে আবার মরিশাস যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। আমি না গেলে বাবাকে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। পরে মরিশাসে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের সহযোগিতায় গত ৩১ আগস্ট আমার বাবা দেশে ফিরে আসেন।’

শান্তা বলেন, আমি বড়বোনের উৎসাহে অনিল কোহলি, শাহ আলম,  মেসার্স গোলাম রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের তিন কর্মকর্তা আকবর হোসেন, গোলাম রাব্বী, আক্তার হোসেন, ফোরকান, আসলাম ও সিদ্দিকসহ অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই রাজধানীর রামপুরা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ দমন আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ বিভিন্ন ধারায় মামলা করি। পুলিশ আসামি আক্তার হোসেনকে গ্রেফতার করেছে। মামলা করার পর শাহ আলম আমাকে শ্লীলতাহানির কিছু গোপন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমি তার বিরুদ্ধে জিডি করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখায় দিয়েছি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মামলার তদন্ত অব্যাহত আছে। এক আসামি গ্রেফতার হয়েছে। অপর আসামিরা আত্মগোপনে আছে। কয়েক আসামি বিদেশে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

শান্তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাসমিয়া নোহিয়া আহমেদ বলেন, ‘কাজের প্রলোভন দেখিয়ে পরিকল্পিতভাবে পাচার করা হয়েছে তাকে। তার ওপর ভয়ানক নিপীড়ন করা হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর