শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

অর্থনীতির নতুন সংকট ই-কমার্স জালিয়াতি

মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নিয়ন্ত্রকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ উন্নয়ন সহযোগীদের

মানিক মুনতাসির

অর্থনীতির নতুন সংকট ই-কমার্স জালিয়াতি

জীবনকে সহজ করতে ও সময় বাঁচাতে দেশে অনলাইন কেনাবেচা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে কেনাকাটার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আবার প্রতি বছর এ খাতে অন্তত ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। মহামারী করোনার আঘাতে গত বছরের বিভিন্ন সময়ে কাজ হারান বিপুল সংখ্যক মানুষ। তাদের মধ্যে বড় একটা অংশ অনলাইন ডেলিভারি ও অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করেন। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। 

সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইন কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। বিশ্বে অনলাইনভিত্তিক শ্রমবাজারের ১৬ শতাংশই বাংলাদেশের। করোনার কারণে যারা চাকরি হারিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে ই-কমার্সে ফিরে আসছেন। কিন্তু এ খাতে মানুষের আস্থা মজবুত হওয়ার আগেই তাতে চির ধরতে শুরু করেছে। সম্প্রতি কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানির জালিয়াতি ও প্রতারণার কারণে দেশের পুরো ই-কমার্স খাত এক ধরনের ইমেজ সংকটে পড়েছে। এই সংকট কাটাতে না পারলে সামনে এটাই দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করে উন্নয়ন সহযোগীরা। অবশ্য তারা এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আনুষ্ঠানিত বিবৃতি দেননি। তবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে একক আলোচনায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, ডিএফআইডি, ইউএসএইডসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ অনলাইন ব্যবসায় (ই-কমার্স) প্রতারণা ও জালিয়াতির বিষয়ে সতর্ক করেছে বাংলাদেশকে। অর্থবিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ই-ক্যাব সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন এর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। আবার ই-কমার্সের একটা বড় দিক হচ্ছে অনলাইন লেনদেন। বাংলাদেশে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিং এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ সেবা পৌঁছে গেছে। এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও দেশে থাকা স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠাতে এখন আর বিভিন্ন ব্যাংক বা এজেন্টদের কাছে ধরনা দিতে হয় না। অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যও ঠিক একই রকমভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। ঠিক এমন সময়ে এ খাতে প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটায় বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব পর্যবেক্ষণ করছেন উন্নয়ন সহযোগীরা। এ খাতের সরকারের নিয়ন্ত্রণ, তদারকির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে উপযুক্ত আইন ও বিধি-বিধানেরও অনুপস্থিতি রয়েছে বলে তারা মনে করেন। এ জন্য এ খাতের সুশাসনের অভাব দেখা দিয়েছে। আর এই সুশাসনের অভাবই ই-কমার্স খাতকে বিতর্কের মুখে ফেলেছে। এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জও। সামনের দিনে ই-কমার্স খাতকে এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে বলে তারা মনে করেন। এ জন্য উপযুক্ত আইন ও বিধিবিধান করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্য এখন দেড় হাজারের বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের তালিকায়ও আছে ১ হাজার প্রতিষ্ঠানের নাম। গবেষণা সংস্থা লাইটক্যাসল পার্টনার্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার দাঁড়াবে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। অথচ পাঁচ বছর আগেও, অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশের এ খাতের বাজারটি ছিল ৫৬০ কোটি টাকার। এ খাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। গত কয়েক বছরে সব মিলিয়ে ই-কমার্স খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের।

ই-কমার্স খাতের প্রসার বেশি হয় করোনাকালে। এ সময় সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা শুরু করে। এতে বড় ক্রেতাশ্রেণি তৈরি হয়। বর্তমানে ই-কমার্স বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।

এই খাত ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে চলতি বছরের মাঝামাঝি এসে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৬ জুন এক প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়, আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির যে সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে ১৬ শতাংশ গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব। এরপর একে একে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ ও কিউকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মালিক ও কর্মকর্তারা ধরা পড়েন। এতে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে অন্যরাও। যার ফলে পুরো ই-কমার্স খাতই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। একইসঙ্গে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা ই-কমার্সের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারেরও রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ছে এ খাতে। জানা গেছে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ঘরে বসে অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা বা ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর গোটা খাতটি এখন ভুগছে আস্থার সংকটে। সম্প্রতি খুব অল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। এমন অবস্থায় ই-কমার্সের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১ (সংশোধিত) এর আলোকে শিগগিরই আইন প্রণয়নের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক এবং ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক আচরণের জন্য এ খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতির অন্যক্ষেত্রেও পড়বে। এই অবস্থায় বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান সংশোধন করা উচিত এবং প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি। এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আরিয়াস কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নিগার সুলতানা বলেন, প্রতারণা বা জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং সেগুলো সবই অন্যের উৎপাদিত জিনিসপত্র বিক্রি করেন। কিন্তু শতভাগ দেশীয় এবং নিজেদের তৈরি পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করেন এমন বহুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের অনেক সুনামও রয়েছে ভোক্তা মহলে। তাদের অনেকেই আজ ইমেজ সংকটে পড়েছেন। অথচ তারা কোনোভাবেই কোনো ধরনের অনিয়ম, প্রতারণা বা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে তিনি মনে করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর