সোমবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

সংসদে দুই মন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা দাবি

ডাবল মাস্ক নিয়ে সিলেট গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বসুন : কাজী ফিরোজ । গুম খুন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে জাতিসংঘে মানবাধিকার সংগঠনের চিঠির বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি হারুনের

নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে প্রাণবন্ত বিতর্ক জমে উঠেছিল জাতীয় সংসদে। সেই বিতর্কে অংশ নেন জাতীয় পার্টি ও বিএনপির এমপিরা। বিএনপির দাবি, সরকার ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বছরে ৩০ কোটি টাকা খরচ করছে। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে লবিষ্ট নিয়োগ করে ৩২ কোটি টাকা পাচার করেছে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যেই জাতীয় পার্টির এমপিরা জানতে চেয়েছেন, আসলে কে লবিস্ট নিয়োগ করেছে? করে থাকলে কোন দল কত টাকা খরচ করেছে? এ টাকা কোথা থেকে খরচ হয়েছে- এসব বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপস্থাপনের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন বিরোধী দলের এমপিরা। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সংসদকে জানান, তিনি এ বিষয়ে আজ জাতীয় সংসদে বিবৃতি দেবেন। এদিকে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভাইস চ্যান্সেলরকে (ভিসি) সরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন জাতীয় পার্টির দুই এমপি। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। গতকাল স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের ১৬তম অধিবেশনের বৈঠকে পয়েন্ট অব অর্ডার এবং রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপরে আলোচনার সময় এসব বিতর্ক হয়। লবিস্ট নিয়োগের অবতারণা করে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও এমপি মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, বিএনপি গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টের পেছনে ৩২ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু কী কারণে তারা এই লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছিল? জনগণের স্বার্থে, নাকি রাষ্ট্রের স্বার্থে? নাকি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে? তা ক্লিয়ার হয়নি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিএনপির একজন নেতা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ক্ষমতাসীন দল ২০১৪ সাল থেকে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। তার দাবি, ক্ষমতাসীন দল লবিস্টের পেছনে ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৩০ কোটি টাকা প্রতিবছর খরচ করে আসছে। মুজিবুল হক বলেন, ‘এ বিষয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষমতাসীন দল আসলেই কি লবিস্ট নিয়োগ করেছিল? কী কারণে? এই টাকা কি সরকারের কোষাগার থেকে গেছে? নাকি দলের নিজস্ব সোর্স থেকে? দেশবাসীসহ আমরা জানতে চাই, বিএনপি লবিস্ট নিয়োগের টাকা কোত্থেকে পেল? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও লবিস্ট নিয়োগ করেছিল কি না, করলে ফান্ড কোত্থেকে পেল? এ বিষয়ে নিরপেক্ষ সংস্থার তদন্ত বা সরকারের একটি বিবৃতি চাই। দেশের মানুষকে এটা জানানো হোক।’

এ বিষয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘জাতির সামনে অনুমাননির্ভর বক্তব্য উপস্থাপন করা ঠিক নয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক বক্তব্য দিতে হবে। ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘকে নোটিস করেছে র‌্যাবকে শান্তিরক্ষা মিশনে না নিতে। সেটার কী অবস্থা? যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার কী অবস্থা? এসব নিয়ে আগামী দিন সুস্পষ্ট তথ্যসহ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বিবৃতি দেবেন বলে আশা করি। বিএনপি আসলে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে কি না, আওয়ামী লীগ করেছে কি না- এসব বিষয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বিবৃতি দিতে হবে।’ রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, জনগণের করের কোটি কোটি টাকা খরচ করে দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকায় লবিস্ট ফার্ম পুষছে সরকার। তিনি দাবি করেন, একটি ফার্ম বিজিআরকে গত বছর সরকার ত্রৈমাসিক ৮০ হাজার ডলার করে দিয়েছে, বছরে যার পরিমাণ ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার (আনুমানিক ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা)। বিজিআর ছাড়াও গত বছর সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডল্যান্ডার গ্রুপের সঙ্গে ৪০ হাজার ডলারে এক মাসের জন্য একটি চুক্তি করেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম। এ ছাড়া কোনওয়াগো কনসালটিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার এক মাসের জন্য আরেকটি চুক্তি করে। ৩৫ হাজার ডলার অগ্রিম দেওয়ার শর্তে চুক্তিটি হয়, যাতে সই করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। রুমিন আরও দাবি করেন, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ অ্যালক্যাড অ্যান্ড ফে নামের লবিং প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ১২ লাখ ডলারের (১০ কোটি টাকা) বেশি দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আর সব মন্ত্রী প্রথমে খুব কড়া ভাষায় আমেরিকাকে আক্রমণ করলেও এখন গলার স্বর নিচু। এখন নিজেদের সমস্যা খতিয়ে দেখার আলাপ হচ্ছে। প্রয়োজনে লবিস্ট, ল’ফার্ম নিয়োগের কথা হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ কোনো নতুন বিষয় নয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংকট প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই সিলেটের শাহজালালে শিক্ষার্থীরা ভিসি ও হাউস টিউটরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ১১ দিন ধরে অনশনে। তাদের ১৬ জন ইতিমধ্যে হাসপাতালে। এতেও টনক নড়ছে না কারও। আলোচনা করতে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় ডেকেছেন শিক্ষামন্ত্রী। ছাত্র আন্দোলন আমরাও করেছি। আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে ছাত্ররা আসবে না আমরা জানি। মন্ত্রীর উচিত ছিল ওখানে ডাবল মাস্ক পরে যাওয়া। মোনায়েম খান বহুবার আমাদের বঙ্গভবনে ডেকেছেন। আমরা ছাত্ররা বঙ্গভবনের দাওয়াতও কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেছি। ছাত্ররা কেন আসবে আপনার কাছে? প্রতিটি ছাত্র আন্দোলন এ দেশে হয়েছে যৌক্তিকভাবে। যখনই যারা সরকারে থাকে সে আন্দোলনকে তারা অযৌক্তিক মনে করে। ভিসি সরাতে ছাত্ররা যদি অনশন করে এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু নেই। বুঝতে হবে তার ওপরে ছাত্রদের কোনো আস্থা-বিশ্বাস নেই। ওনার যদি বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ থাকত তাহলে অবশ্যই তিনি সরে আসতেন। উনি জোর করে বসে আছেন পুলিশি সহায়তায়। ছাত্ররা গিয়েছিল, কিন্তু হাউস টিউটরের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। ছাত্রদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছেন হাউস টিউটর। সেখান থেকেই ঘটনার উৎপত্তি। তখন ছাত্রছাত্রীরা ভিসির কাছে গিয়েছিল। ভিসি তাদের সরিয়ে দিয়েছেন। কথা বলেননি। এর পরই তারা আন্দোলন করল। আর আন্দোলনের পরই পুলিশ ডেকে আনল। এটা কি আইয়ুব, মোনায়েম খানের আমল নাকি যে কথায় কথায় পুলিশ আনবেন? লাঠিপেটা করল, কাঁদানে গ্যাস মারল আমরা দেখলাম। কেন এটার উৎপত্তি হলো? কোনো ছাত্র আন্দোলনকে ছোট করে দেখা উচিত নয়।

আমি মনে করি অবিলম্বে, আর কোনো তদন্ত রিপোর্ট নয়, কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনা নয়, শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী আছেন, ভিসিকে আজকের মধ্যেই ওখান থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসেন, ছাত্রদের ক্লাসে ফিরে যেতে সহায়তা করেন।’ আরেক সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার আন্দোলন চলছে। শিক্ষার্থীরা ভিসির সঙ্গে আলাপ করতে গেলে গ্রেনেড হামলা, লাঠিপেটা করা হয়েছে। ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করার কারণেই ভিসির পদত্যাগের দাবিতে তারা আন্দোলন শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে ভিসি কোনো আলোচনা না করার কারণে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনে গেছে। অনশনে অসুস্থ হয়ে শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ভিসি আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জের মতো পদে আছেন। যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভিসিকে চায় না কিন্তু লখিন্দরের বাসার মতো সুরক্ষা নিয়ে নিজের বাসায় বসে আছেন। তিনি পদত্যাগ করবেন না। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন না। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে না চাইলে সরকারের উচিত আজকের মধ্যে তাকে অব্যাহতি দেওয়া। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও এ সময় অধিবেশেনে উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি কোনো কথা বলেননি।

সর্বশেষ খবর