শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ইসি গঠন আইন পাস

আগের ইসিকে ছাড় দেওয়া হয়নি : আইনমন্ত্রী নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন হারুনের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইসি গঠন আইন পাস

আগের দুটি সার্চ কমিটির বৈধতা দিয়েই বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন-সংক্রান্ত আইনের বিল ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল, ২০২২’ গতকাল পাস করেছে জাতীয় সংসদ। এর আগে সংসদীয় কমিটির আনা দুটি সংশোধনীর পাশাপাশি সংসদে আনা এমপিদের ২২টি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়। তবে ৯ নম্বর ধারার কোনো সংশোধনী গৃহীত হয়নি। বিএনপি এ ধারার মাধ্যমে আগের নির্বাচন কমিশনকে ইনডেমনিটি দেওয়ার অভিযোগ তুলে আইনটি প্রত্যাখ্যান করার কথা জানিয়েছে। তারা বলেন, আইনটি পাসের চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিই বেশি গ্রহণযোগ্য। বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদ নির্বাচনব্যবস্থার সমালোচনা করে বলেন, ‘২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এ আইন একটি আইওয়াশ।’ জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘দফা ৯-এ কারও কৃতকর্মকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি আদালতের রায়ে বাতিল হয়েছে। এর পরও তারা বলবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার! তারা দেশে আদালতের রায়ও মানেন না। তারা (বিএনপি) ইনডেমনিটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে দেয়নি। সত্য হচ্ছে যারা খুনি তারা তাদের পুনর্বাসিত করেছে। এসব সত্য মেনে জনগণের কাছে ক্ষমা চান তারপর আমরা ঐকমত্যে আসব।’ স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে একাদশ জাতীয় সংসদের ১৬তম অধিবেশনের সমাপনী দিনে গতকাল সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে সার্চ কমিটিতে একজন নারী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করাসহ সার্চ কমিটির রিপোর্ট প্রদানের মেয়াদ পাঁচ দিন বৃদ্ধি করে ১৫ কার্যদিবস করার বিধান যুক্ত করে বিলটি পাস হয়। এ ছাড়া বিলের প্রধান শিরোনামে ‘অন্যান্য’ শব্দ যুক্ত করে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংসদের স্থিরকৃত আকারে পাসকৃত বিলের শিরোনাম ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল, ২০২২’। রাষ্ট্রপতি এ বিলে সই করলে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করার পর বিলটি আইনে পরিণত হবে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন পাবে বাংলাদেশ। সংসদে বিলটি পাস করার প্রস্তাব করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এর আগে বিলের আনা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণ এবং অধিকাংশ সংশোধনী নাকচ হয়ে যায়। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ জাসদ ও ওয়ার্কার্স পাটির সংসদ সদস্যরা বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব দেন। বিলের ওপর আনা ৬৪টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ২২টি গ্রহণ করেন আইনমন্ত্রী, যা সংসদে ভোটের মাধ্যমে পাস হয়। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সার্চ কমিটিতে রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী প্রতিনিধি রাখার সংশোধনী প্রস্তাবে সম্মতি দেন আইনমন্ত্রী। ফলে প্রস্তাবটি ভোটের মাধ্যমে সংসদে গৃহীত হয়। এতে ইসি গঠনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটিতে একজন নারী প্রতিনিধি থাকার বিধান যুক্ত হয়। একইভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে সার্চ কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার মেয়াদ ১০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৫ কার্যদিবস করার সংশোধনীও গ্রহণ করে সংসদ। বিলের শিরোনাম ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল’-এর স্থলে শিরানামে ‘এবং’ শব্দের পর ‘অন্যান্য’ শব্দ যুক্ত করার সংশোধনী গ্রহণ করে সংসদ। ফলে পাসকৃত বিলের শিরানাম হয় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল, ২০২২’। তবে বিলের ৯ নম্বর ধারা ‘হেফাজত’ সম্পর্কে বিএনপির আনা সংশোধনী গৃহীত হয়নি। ৯ নম্বর ধারায় আগের দুটি সার্চ কমিটিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইতোপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বৈধ ছিল বলে গণ্য হবে এবং উক্ত বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।’ এ বিষয়ে সংসদ ভবনের গেটে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘দফা ৯-এ পরিষ্কার পড়ে দেখেন, কারও কৃতকর্মকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আইনে দুটি জিনিস আছে। একটি ইনডেমনিটি আর একটি লিগ্যাল কাভারেজ। দুটি এক নয়। ইনডেমনিটি হচ্ছে মাফ করে দেওয়া, আইনের আওতা থেকে বের করে দেওয়া। লিগ্যাল কাভারেজ হচ্ছে আইনের ভিতরে আনা।’ সংশোধনীগুলো গ্রহণের সময় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বিরোধী পক্ষের সর্বোচ্চসংখ্যক সংশোধনী গ্রহণ করেই পাস হলো আইনটি। ব্যাপারটা হচ্ছে তালগাছটা না পেলে অনেক অভিযোগ থাকে, ঠিক আছে। আমার কথাটা সেটা নয়। এই যে সার্চ কমিটির কথাটা, এই সার্চ কমিটির কথাটা তো ২০১২ সালের সেই কনসেপ্টের ফল। এটা তো আজকের কোনো নতুন কিছু না।’ সংশোধিত বিলের ৫(গ) ধারায় যোগ্যতার ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটির সংশোধনের সুপারিশমতো, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনার হতে গেলে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি বা বেসরকারি পদের’ পর ‘বা স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশা’ ?শব্দগুচ্ছ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ফলে সংশোধিত আকারে গৃহীত ধারায় বলা হয়, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনার হতে গেলে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি বা বেসরকারি “বা স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশা”য় অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।’ বিলের ৬(ঘ) ধারায় অযোগ্যতার ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটির সংশোধনের সুপারিশমতো, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বাক্যের পর ‘অন্যূন দুই বৎসরের’ শব্দগুলো বিলুপ্ত করা হয়। ফলে সংশোধিত ধারায় বলা হয়, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনার নিয়োগের জন্য নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদন্ডে দন্ডিত হলে তিনি অযোগ্য বিবেচিত হবেন। অর্থাৎ নৈতিক স্খলন ফৌজদারি অপরাধে যে কোনো মেয়াদের সাজা হলেই আর কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বা কমিশনার হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।’ বিলটি পাসের সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন, আইনটি ‘তড়িঘড়ি করে’ আনা হয়েছে। এর জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে। যারা সংলাপে যাননি এবং গিয়েছেন তারা সবাই আইনের কথা বলেছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আইনের বিষয়ে তাঁর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আমরা তড়িঘড়ি করিনি। এ আইনের কথা অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালেই এ আইনের কথা উঠেছিল।’ এ সময় আইনমন্ত্রী সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) তৈরি এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়া থেকে পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ওই দুটির সঙ্গে সরকারের আনা বিলের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। এর আগে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবের আলোচনার সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা সার্চ কমিটিতে সংসদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন। বিলটির নানা দিকের সমালোচনা করেন তারা। রাষ্ট্রপতি এ বিলে সই করলে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করার পর বিলটি আইনে পরিণত হবে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন পাবে বাংলাদেশ। এ আইনের অধীনে ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি এ সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক, যার মধ্যে একজন হবেন নারী। বিলে তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির সভার কোরাম হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আর কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সার্চ কমিটির (অনুসন্ধান কমিটি) কাজ সম্পর্কে বিলে বলা হয়েছে, এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। কমিটি সিইসি ও অন্য কমিশনারদের প্রতিটি পদের জন্য দুজন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিতে হবে। বিলের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু সার্চ কমিটি সম্পর্কে বলেন, বাছাই প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ হবে, স্বচ্ছ হবে এবং কোনো রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে হবে না। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘কিছু লোক অহেতুক ফতোয়া দেয়। এই যে সুজন, তার নির্বাহী সম্পাদক আমার বন্ধু বদিউল আলম মজুমদার আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কিছু ফতোয়া দিয়েছেন। তারা তো নির্বাচন করেন না, তারা ফতোয়া দেওয়ার কে? আমরা বলব, যারা নির্বাচন করি, যারা স্টেকহোল্ডার আছেন, আমরা বলব কীভাবে নির্বাচন হবে। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করলে ভালো হবে।’ বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এখানে একটি কূটকৌশল অবলম্বন করছেন। মানুষ আজ স্পষ্টভাবে চিন্তা করছে ২০১৪ সালে বিনা ভোটে সংসদ গঠন হয়েছে। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। মানুষ এখন চিন্তা করছে আগামী দিনের ভোট, দিনের আলোয় নতুন করে আরও কোনো নতুন কৌশলের মাধ্যমে করবেন কি না?’ বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর কোনো নির্বাচন বাংলাদেশে সম্ভব নয়।’ তবে এর বাইরেও মত দিয়েছেন অন্য সংসদ সদস্যরা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর