শিরোনাম
শনিবার, ১৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

পোশাক খাতে ব্যবসা রমরমা

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে দেশ

রুহুল আমিন রাসেল

পোশাক খাতে ব্যবসা রমরমা

অবাক হলেও সত্যি বাংলাদেশি পোশাকশিল্প মালিকরা এখন আর বেশি দাম না পেলে বৈশ্বিক ক্রেতাদের অর্ডার বা ক্রয়াদেশ নিচ্ছেন না। ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, পোশাক খাতে ব্যবসা এখন রমরমা। কারখানাগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ ক্রয়াদেশ ও রপ্তানির তথ্য দিয়েছে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। আর ইপিবি বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই পুরো অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।  বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ায় সার্বিক রপ্তানিতে বড় উল্লম্ফন দেখছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই পুরো অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। ফলে অর্থবছর শেষে পণ্য রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চলতি অর্থবছর পণ্য রপ্তানি ৭ বিলিয়ন ডলার বাড়বে বলে মনে করছেন অংশীজনরা। বাংলাদেশের রপ্তানিতে বরাবরের মতো শীর্ষ স্থানে রয়েছে তৈরি পোশাক। গত এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। শুধু এপ্রিলে ৩৯৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৫৬ শতাংশের মতো। শুধু তাই নয়, পোশাকশিল্প রপ্তানিতে একাধিক দেশের অর্ডার নিতে পারছে না বাংলাদেশ। চীন ও তাইওয়ানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিভিন্ন দেশের অর্ডার বেড়েছে বাংলাদেশে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনীতির দুরবস্থার ফলে বিদেশি পোশাকশিল্পের ক্রেতারা  ঝুঁকেছেন বাংলাদেশে। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ ভালো হওয়ায় ব্যবসা রমরমা। চীন থেকে ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তর হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগে করোনা থেকে পশ্চিমা বিশ্ব ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। উৎপাদনে ব্যবহৃত তুলাসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বিশ্ববাজারে ৫০ শতাংশ বাড়লেও বৈশ্বিক ক্রেতারা পোশাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেননি। মাত্র ১০ শতাংশের মতো মূল্য বেড়েছে। ফলে পোশাক খাতে ৩০ শতাংশ আয় বাড়লেও মালিকদের মুনাফা প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না। ভালো মূল্য না পাওয়ার পেছনে মালিকদের দরকষাকষিতে ঘাটতি ও দুর্বলতা আছে। খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে ইউরোপের দেশগুলো প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা খাচ্ছে। ফলে আগামীতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হলে পোশাকশিল্পের এই চাঙাভাব নাও থাকতে পারে। কারণ, পোশাক খাতের কাঁচামালের দাম বাড়ছে। ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি ধরে যদি কাঁচামালের দাম বাদ দেওয়া হয়, তাহলে মূল্য সংযোজন বা ভ্যালুএডিশন খুব কম। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত পোশাকশিল্পের অবস্থা এমন থাকবে, তারপরে কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সহসভাপতি মো. শহিদুল্লাহ আজিম বলেন- এটা সত্য যে, পোশাকশিল্পের ব্যবসা এখন রমরমা। রেকর্ড পরিমাণ ক্রয়াদেশ ঠিকই আছে। তবে লাভ সঠিক মাত্রায় নেই। যদিও সব কিছুর খরচ বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। তুলা ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তারপরও মালিকরা এত দিন ক্রেতা ধরে রাখতে ক্রয়াদেশ নিয়েছেন। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। এখন পোশাক পণ্যের মূল্য না বাড়ালে ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ নিচ্ছেন না মালিকরা। প্রত্যাশিত লাভ না হলে ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ক্রেতারা চাইলেও ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের পোশাকশিল্প মালিকরা নিচ্ছেন না বলে সাফ জানিয়েছেন বিজিএমইএ এই নেতা।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএ উপদেষ্টা ও সংগঠনটির সাবেক প্রথম সহসভাপতি এ এইচ আসলাম সানী বলেন, পোশাক খাতের সঙ্গে মালিকদের ভালোবাসা তৈরি হওয়ায় ব্যবসা এখন রমরমা হচ্ছে। তবে ব্যবসা রমরমা হলেও লাভ রমরমা নয়। এখনো পোশাকশিল্প কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগোচ্ছে।

নিট পোশাকের এই শীর্ষ রপ্তানিকারকের মতে, মূলত দুই কারণে পোশাকশিল্পের ব্যবসা এখন রমরমা। একটি হলো- মহামারি করোনা ভাইরাসের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা ক্রেতাদের কাছে পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছেন। সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্যোক্তারা এগিয়েছেন। এরমধ্যে করোনায় শ্রমিকদের সুরক্ষা অন্যতম। এ এইচ আসলাম সানী আরও বলেন, করোনাকালে সরকারি ঋণ প্রণোদনা শিল্প সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। চীন-তাইওয়ানের মতো দেশ এখন প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ক্রেতাদের পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না, কিন্তু আমরা সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছি। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির পরও আমরা টিকে গেছি। চট্টগ্রাম বন্দরে খরচ বেশি। জাহাজের ভাড়া বাড়ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি। যুদ্ধের প্রভাব বাড়ছে। ব্যবসার খরচ বাড়ছে। এসবের মধ্যে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকশিল্প মালিকরা ভালো প্রতিযোগিতা করছেন, কিন্তু স্বস্তিতে নেই।  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সূত্র বলছে- পোশাকশিল্পে বৈশ্বিক ক্রেতারা তাদের অর্ডার এখন বিভিন্ন দেশ থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে আনছেন। ফলে দেশে এখন তৈরি পোশাকের রপ্তানি ক্রয়াদেশের ঢল বইছে। কম বেশি সব পোশাক কারখানায় এখন রাত-দিন কাজের ধুম পড়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকেই করোনার ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশের রপ্তানি খাত। এরপর প্রায় প্রতি মাসেই আগের মাসের চেয়ে রপ্তানি বাড়ছে। ডিসেম্বরে রেকর্ড ৪০৪ কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করে তৈরি পোশাকের রপ্তানি। জানুয়ারিতে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৯ কোটি ডলারে। ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানির পরিমাণ ৩৫১ কোটি ডলার। মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে রপ্তানি আগের একই সময়ের চেয়ে বেশি হয়েছে ৫২ শতাংশ। মোট ১৬৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ১০১ কোটি ডলারের পোশাক। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিওর সর্বশেষ ২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব পোশাক বাজারে চীনের অংশ ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের অংশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ইপিবি বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সেই ব্যবধান আরও বেড়েছে। এই সাত মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে যে ২৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে তার মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১৩ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। আর ওভেন থেকে এসেছে ১০ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে পোশাক রপ্তানি থেকে যে বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে তার মধ্যে ৫৫ দশমিক ৩৪ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৩ শতাংশ। আর ওভেনে রপ্তানি বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে মোট ৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলার। পোশাক রপ্তানি থেকে লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের (ইউএসআইটিসি) পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে দুই বছর পর আবারও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই শতাংশের কিছু বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশেরও বেশি। তবে, পঞ্জিকা বর্ষ অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৫ শতাংশ। জানা গেছে, একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় এসেছে ২৪১৭ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এসেছে ৪০৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার। যা মোট রপ্তানির ৬ শতাংশ। এ বাজারে বাংলাদেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক। ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৫৮৪ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই শতাংশ বেড়ে রপ্তানি হয় ৫৯৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এরপর চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস তথা জানুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৪০৪ কোটি ৪২ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩৪৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭.৪৪ শতাংশ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর