বুধবার, ১ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

হাতের ইশারায়ই চলে ট্রাফিক সিস্টেম

স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে ২২ বছরে জলে গেল ১৪৬ কোটি টাকা, আসছে নতুন প্রকল্প

হাসান ইমন

হাতের ইশারায়ই চলে ট্রাফিক সিস্টেম

রাজধানীতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাস্তবায়নে গত ২২ বছরে প্রায় ১৪৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের আধুনিকায়নের জন্য কিছু উচ্চাভিলাষী পরীক্ষা-নিরীক্ষাও ছিল। যেমন-সিগন্যাল লাইট ডিজিটালকরণ এবং কিছু ব্যস্ততম মোড়ে টাইমার কাউন্টডাউন ও ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন এবং রিমোটের মাধ্যমে সিগনাল বাতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু কোনো পরিকল্পনায় কাজ হয়নি। আর এখন হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা শহরকে সচল করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো করে প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু কোনোটি সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ তারা নিজেদের স্বার্থে প্রকল্পগুলো নিয়েছে। অথচ কৌশলগত পরিকল্পনা (এসটিপি) ২০০৫ সালে এবং সংশোধন হয়েছে ২০১৫ সালে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এই এসটিপির পরিকল্পনা যদি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে ঢাকা শহরের আজ এ অবস্থা হতো না।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রাস্তার ধারণক্ষমতা বিবেচনা না করেই নতুন নতুন যানবাহন চলাচলের অনুমতি দিচ্ছি। যানবাহনের চাপে কোনো সিগন্যাল সিস্টেমই কাজ করবে না। আমাদের আগে রাস্তার ধারণক্ষমতা এবং যানবাহনের সংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখার কথা ভাবতে হবে।’

জানা গেছে, ২০০১ সালে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের অধীনে স্বয়ংক্রিয় সংকেত প্রবর্তনের মাধ্যমে ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন দেখা যায়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০১-০২ সালে ৯টি এবং ২০০৫ সালে ৫৯টি ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। ২০০৬ সালে সরকারকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক জানায়, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০১২-১৩ সালে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আরেকটি প্রকল্পের আওতায় ৭০টি ক্রসিংয়ে সোলার প্যানেল এবং টাইমার কাউন্টডাউন সিস্টেম যুক্ত করে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে, ২০১১-১২ সালে ১৫ কোটি টাকায় সোলার প্যানেল ও টাইমার কাউন্টডাউন স্থাপন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে ২০১৩ সালে নতুন সিগন্যাল লাইট স্থাপনে আরও সাড়ে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু ট্রায়ালেই ব্যর্থ হয়ে সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশ বাধ্য হয় নতুন সিগন্যাল সিস্টেম বাদ দিয়ে পুরনো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ফিরে যেতে হয়। পরে আবার ২০১৮ সালে একই প্রকল্পে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের মধ্যে ভারত থেকে ১৩৪টি রিমোট আনা হয়। এ প্রকল্পে ২৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়। পাইলটিং হিসেবে ৬টি স্থানে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ট্রাফিক সিস্টেম চালু হলেও এক বছর পরে তা নষ্ট হয়ে যায়। 

এ বিষয়ে তৎকালীন প্রকল্পের পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। পরে এটি ট্রাফিক সার্কেলকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সিগন্যাল বাতিগুলো নষ্ট হওয়া শুরু করে। এখন দু-একটা জায়গায় আছে, তাও রিমোট সিস্টেম নেই। তবে বাতিগুলোর সর্বশেষ কী অবস্থা তা আমার জানা নেই।

এ ছাড়া ডিএমপি ১৭টি বড় এবং ১৪টি ছোট ডিজিটাল বোর্ড ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ট্রাফিক নিয়ম ও গতিসীমা প্রদর্শনে বসানো হয়। কিন্তু এগুলো অনেকাংশেই উপেক্ষিত। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ডিসপ্লে স্থাপন করেছে। মেট্রোরেল এবং ইউলুপ নির্মাণের মতো চলমান প্রকল্পের জন্য এর অনেকটি সরিয়েও ফেলা হয়েছে।

ইনটেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম : রাজধানীর যানজট নিরসনে ২০১৫ সালে ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ কোটি ৮ লাখ টাকা। এতে ১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি টাকা বাংলাদেশের। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে তিন দফা সময় বাড়ে। কিন্তু গত জুনে কাজ শেষ করার সর্বশেষ লক্ষ্যও পূরণ হয়নি। প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে গুলশান-১, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান) মোড়ে আইটিএসের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। পরের বছর, জাপান থেকে আইটিএস সফটওয়্যারসহ দুটি বিশেষ কম্পিউটার আনা হয়। তবে এর মধ্যে একটি স্থাপনের আগেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গুদাম থেকে চুরি হয়ে যায়। চুরির পর দুই বছরের জন্য প্রকল্পটি স্থগিত করার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের মোট ব্যয় না বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ বাজেট সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সার্ভার সংগ্রহ করে কাজ শুরু করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে ডিটিসিএ নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সর্বশেষ আমরা যে স্থানগুলোতে বসাব, সে বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মতামত চাওয়া হয়েছে। তারা এখনো মতামত দেয়নি। তাদের মতামত হাতে পেলে কাজ শুরু হবে। প্রকল্পটির মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে সপ্তাহ খানেক রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় সিগন্যাল বাতির কোনো কার্যকারিতা নেই।  দু-এক জায়গায় বাতি জ্বললেও কোনো নিয়ম-নীতি নেই। কোথাও বাতি জ্বলছে তো জ্বলছেই, পরিবর্তন আর হচ্ছে না। আর যেখানে পরিবর্তন হচ্ছে, সেখানে বাতির সিগন্যাল বাতিল হচ্ছে দায়িত্বরত পুলিশের হাতের ইশারায়।

নতুন প্রকল্প নিচ্ছে ডিএসসিসি : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৫৩ ইন্টারসেকশনে আর্টিফিশিয়াল ট্রাফিক সিস্টেম চালু করবে। এ উদ্যোগে ডিএসসিসি নগর ভবনে কন্ট্রোল রুম থাকবে। কন্ট্রোল রুম থেকে ট্রাফিক সিগন্যাল মনিটরিং করা হবে। এ ছাড়া প্রতিটি সিগন্যালে সার্ভার থাকবে,  যে সার্ভার সড়কের কোন পাশে গাড়ির চাপ বেশি সেটা অটো নিয়ন্ত্রণ করবে। সে অনুযায়ী লাল ও সবুজ সিগন্যাল দেবে। এ বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে খুব শিগগির আর্টিফিশিয়াল ট্রাফিক সিস্টেম প্রকল্প নেওয়া হবে। আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। পরামর্শক সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিলে যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প তৈরি করা হবে।

সর্বশেষ খবর