মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে উদ্বেগ টিআইবির

সব দেশেই দলীয় সরকারের অধীনে হয় : সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ভূমিকা নিশ্চিত করতে আইন সংস্কার করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) প্রস্তাব দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একই সঙ্গে সব দলের অংশগ্রহণ ও সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতসহ মোট ১০টি সুপারিশ করেছে। গতকাল নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে সাক্ষাতে এসব সুপারিশ করা হয়। তাদের এসব সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি বলেছেন, সব দেশেই নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই হচ্ছে। ভারতেও হচ্ছে, বিলেতেও হচ্ছে, আমেরিকাতে হচ্ছে। সরকার কিন্তু সরকার। দল ও সরকার ভিন্ন জিনিস।

মন্ত্রীরা পক্ষপাত করবেন না- এমন শপথ নেন জানিয়ে সিইসি আশা প্রকাশ করেন, সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচনের স্বার্থে উনারা (মন্ত্রীরা) নির্বাচনকালীন সরকারে থেকে সরকারের মতোই আচরণ করবেন। একজন মন্ত্রী কিন্তু দলের নয়, সরকারের। আমরা চাই তারা আমাদের সহযোগিতা করুক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি এ কথা বলেন।

সিইসি বলেন, সব দেশেই তো দলীয় সরকারের অধীনেই হচ্ছে। ভারতেও হচ্ছে, বিলেতেও হচ্ছে, আমেরিকাতে হচ্ছে। সরকার কিন্তু সরকার। দল ভিন্ন জিনিস। আমরা যদি এই বিভাজনটা স্পষ্ট করতে পারি, এই মেসেজটা দিতে পারি, যখন ক্যাবিনেট যেটাকে বলা হয়- রাষ্ট্রপতি থেকে বা প্রধানমন্ত্রী থেকে ডেপুটি.., এটাই কিন্তু মূল সরকার। বাকি যারা আছে সেটা কিন্তু আমলাতন্ত্র। কাজেই যে সরকার যেটা আছে, তারা কিন্তু শপথ নিয়েছেন, সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করব, সমআচরণ করব, পক্ষপাতিত্ব করব না। উনারা বলেন নাই যে আমরা আমাদের দলকে আগামীতে আরও বেশি করে হেল্প করব। স্বভাবতই উনারা বলেন না। আমার বিশ্বাস উনারা উনাদের শপথটা জানেন। নির্বাচনের সময় অন্তত একটা সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচনের স্বার্থে উনারা নির্বাচনকালীন সরকারে থেকে সরকারের মতোই আচরণ করবেন। সরকারের মন্ত্রী হিসেবে কোনো দলের মন্ত্রী হিসেবে নয়। নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় যে সরকার থাকবে সেটাই নির্বাচনকালীন সরকার। অপজিশন থেকে যে দাবিগুলো করা হচ্ছে এগুলো নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যে এই সব বিভিন্ন সরকার, সেটা কিন্তু আমাদের বিষয় নয়। এটা সাংবিধানিক বিষয় পলিটিক্যাল লিডাররা যদি একমত হন তারা দেখবেন। আমার কাছে মনে হয় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বর্তমানে যে আইন আছে, সেটাই নির্বাচনকালীন সরকার। তার সঙ্গে আমাদের ইন্টারঅ্যাকশন বেড়ে যাবে। একজন মন্ত্রী কিন্তু দলের নয়। আমরা চাই তারা আমাদের সহযোগিতা করুক। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার বর্তমান যে সরকার তার ধরন পাল্টে যাবে, তখন পলিসি নিয়ে উনারা কাজ করবেন না। পৃথিবীর সব দেশেই এটা আছে। নির্বাচনের কাজে আমাদেরকে সহায়তা করতে হবে।

সিইসি আরও বলেন, আইনকানুন যেটা আছে সরকার আমাদের সহযোগিতা করতে বাধ্য। সব নির্বাচনে আমরা সরকারের কাছে সহায়তাগুলো চাইব এবং অবশ্যই সরকার সে সহযোগিতাগুলো করবে বলে আশা করি। সহায়তা মূলত পুলিশ প্রশাসন ও জনপ্রশাসন কেন্দ্রিক আর ডিফেন্স মিনিস্ট্রি। অন্য কোনো মিনিস্ট্রি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই। জনপ্রশাসন যেহেতু জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হ্যান্ডেল করে, তারপর পুলিশ প্রশাসনকে হ্যান্ডেল করে হোম মিনিস্ট্রি, আর সশস্ত্র বাহিনীকে যদি ইনভলব করা হয়, তাহলে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি লাগবে। আর একই কথা বারবার বলেছি, নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হওয়া খুবই প্রয়োজন। যেভাবেই হোক যদি মূল বিরোধী দল নির্বাচনে না আসে, তাহলে নির্বাচন স্বচ্ছ হোক, অস্বচ্ছ হোক, যাই হোক ওটার কিন্তু গুরুত্ব, গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে যাবে। কারণ ডেমোক্রেসির মূল কথাই হচ্ছে পজিশন এবং অপজিশন। তিনি বলেন, আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে যেটা দেখি সেটা কিন্তু গভর্মেন্ট নয়। তারপর জয়ী হয়ে যেটা পার্লামেন্টে আসে দ্যাট ইজ পার্ট অব দি গভর্মেন্ট, লেজিসলেটার এবং লেজিসলেটার কিন্তু যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা ট্রেজারি বেঞ্চ। তাদের কাজই হচ্ছে সমালোচনা করা। এই সমালোচনার মাধ্যমেই কিন্তু এক ধরনের জবাবদিহিতা গড়ে ওঠে এবং সতর্কতা হয়। এ জন্য আমরা চাই নির্বাচনটা অংশহগ্রহণমূলক হোক।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, উনাদের বলেছি, আপনারাও যারা পলিটিকস করেন না, পলিটিক্যালস ঊর্ধ্বে একটা অবস্থান আপনাদের আছে। প্রতিদিন যে আক্রমণাত্মক কমেন্টগুলো দিচ্ছে, সেখানে সরিয়ে নিয়ে এসে যদি টেবিলে মুখোমুখি করা যায়, তাহলে আলোচনা হবে গঠনমূলক। টেবিলের বাইরে গিয়ে যদি ধারাবাহিকভাবে আক্রমণাত্মক বক্তব্য পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দেয়, তাহলে কিন্তু দূরত্ব কমবে না। কারণ আমরা চাচ্ছি নির্বাচনে সব পার্টি অংশগ্রহণ করুক। সিইসি আরও বলেন, পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। নির্বাচন যদি সহিংসতার কারণে বিঘ্নিত হয়ে যায় আমাদের ক্ষমতা আছে যে কোনো একটি সেন্টার বা নির্বাচনটা বাতিল করে দেব। আমরা সে ব্যাপারে সতর্ক থাকব। বিরূপ পরিবেশ যাতে না হয়, আমরা চাইব নির্বাচনে যাতে ভোটাররা যেতে পারে এবং নির্বিঘ্নে যেন ভোট দিতে পারে, সেই খবরটা আমরা রাখব। আর প্রচণ্ড রকম সহিংসতা যদি হয়ে যায়, তাহলে আমরা ক্ষমতা যেটা রয়েছে, দায়িত্ব রয়েছে আমি বলব সেই সেন্টার বা কনস্টিটোয়েন্সি (আসন) বাতিল করে দিতে পারব।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে উদ্বেগ টিআইবির : সিইসির সঙ্গে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন যেভাবে মনে করেন-একটা নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সেটি সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনাপ্রসূত পরামর্শ সরকারকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দিতে পারে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার আগে প্রস্তাবনা নিশ্চিত করা- কী ধরনের হবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রকৃতি, আচরণ এবং সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিতে পারলে ইতিবাচক হবে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের প্রস্তাবনাগুলো ইতোমধ্যে কমিশনের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তারই ভিত্তিতে আজ আলোচনা করেছি। দেশবাসী চায়- আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের মাধ্যমে যেন নির্বাচনটি হয়। এ জন্য অন্যতম পরামর্শ হচ্ছে- নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র কেমন হবে, আচরণ কেমন হবে, গঠন কেমন হবে। বিষয়গুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কথা তুলে ধরিনি। বিষয়টা যেহেতু দেশবাসীর উদ্বেগের জায়গা- সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কমিশনকে বলেছি।

তিনি কমিশনের প্রতি অনুরোধ জানান, প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কার আনতে পারেন। সবার জন্য সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্য, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা স্বপদে বহাল থেকে নির্বাচন করতে পারেন-তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হয় বলে অনেকের ধারণা। এটাকে পরিবর্তনের প্রস্তাব করবে কি না কমিশন দেখতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, কমিশন অবশ্যই পারে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে পরামর্শ দিতে। ইসি পারে না এমন কোনো কথা নেই। তারা যদি মনে করে- ইসির নিজস্ব বিশ্লেষণে আইনি সংস্কার করতে পারে। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব করবেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেটা বিবেচনা করবেন কি করবেন না- তা পরের বিষয়। কমিশনের সঙ্গে বৈঠককালে নির্বাচনের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ (৪-জি থেকে নামিয়ে ২-জি) করা থেকে বিরত রাখা হয়। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অবাধে সুযোগ, নির্বাচনকালীন তথ্য প্রকাশ, ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইভিএম ব্যবহারসহ নানা পরামর্শ দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

 

 

সর্বশেষ খবর