বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কর্মকর্তাদের অপেশাদার আচরণ

বেপরোয়া মনোভাব, অভিযোগ নাগরিকদের, বিব্রত প্রশাসন

উবায়দুল্লাহ বাদল

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে গত শুক্রবার বিকালে ফুটবলের ফাইনাল খেলা ছিল। এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। খেলার হার-জিত নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলেও একপর্যায়ে তার সুরাহা হয়। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে তাদের উত্তেজিত হয়ে কথা বলাটাকে ‘অসহনশীল’ আচরণ হিসেবে ধরে নেন ইউএনও। তিনি তার বক্তব্যে উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘আপনারা যত দিন পর্যন্ত সহনশীল না হতে পারবেন, তত দিন ট্রফিগুলো আমানত হিসেবে থাকবে। আরেকটি ম্যাচ হলে তারপর দেব।’ ইউএনওর বক্তব্যের জবাবে উপস্থিত সবাই ‘না না’ বলতে থাকেন। এরপর তিনি বলেন, ‘যদি ট্রফি না থাকত, আমরা খেলতাম না? ...আমি ট্রফিটা ভেঙে এখন খেলা শুরু করব’ বলেই তিনি ট্রফি দুটি সবার সামনে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেন। মাঠের এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ইউএনওকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ঘটনাটি সারা দেশের ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ ছিল। গতকাল মেহরুবাকে আলীকদম থেকে ঢাকা বিভাগে বদলি করতে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ন্যস্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শুধু আলীকদমই নয়, কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের অপেশাদার বা অকর্মকর্তাসুলভ আচরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় চরম বিব্রত কেন্দ্রীয় প্রশাসন। ট্রফি ভাঙার ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম। তারা এতটাই বিব্রত যে অফিসে থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি দুজনের কেউই। তাদের নির্দেশে বিষয়টি নিয়ে গত রবিবার সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, ‘ট্রফি (কাপ) ভেঙে ফেলার ঘটনায় ইউএনও মেহরুবা ইসলামের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এসব ঘটনা প্রশাসনকে বিব্রত করে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে  তিনি বলেন, ‘যে কোনো খারাপ কিছুর জন্য সমাজ যেমন বিব্রত হয়, আমরাও বিব্রত হই।’ ট্রফি ভাঙার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন রবিবার পাওয়ার কথা থাকলেও এখনো পাননি বলে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেন আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, ‘তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।’ বান্দরবান থেকে ঢাকায় বদলি এটা তার জন্য শাস্তি না হয়ে পুরস্কার হলো কি না? এমন প্রশ্নে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘বিষয়টাকে এত হালকাভাবে দেখার কিছু নেই। তার চাকরি জীবনের সামনে অনেক সময় বাকি। নিশ্চয় এ ঘটনা তার এসিআরে উল্লেখ থাকবে।’ জানা গেছে, বিদ্যমান সরকারি আচরণ বিধিমালায় উপহার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ ৩৪টি বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা আছে। তবে নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। অবশ্য নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়। তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার অকর্মকর্তাসুলভ আচরণে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রশাসনকে।

যেসব ঘটনায় বিব্রত প্রশাসন : সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভালো আচরণের পাশাপাশি প্রচুর বিব্রতকর আচরণের নজির রয়েছে। সবই গণমাধ্যমে না এলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকায় কিছু কিছু ঘটনা প্রকাশ হচ্ছে। এসব ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি ‘ম্যাডাম’ না বলায় স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর ওপর চটে যান পাবনার বেড়ার ইউএনও ফারজানা খানম। উত্তেজিত হয়ে এ সময় ইউএনও সাংবাদিককে বলেন, ‘আপনি কতদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। আপনি জানেন না একজন ইউএনওকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে হয়?’ ২০১৯ সালের ১৫ মে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ‘ম্যাডাম’ না ডাকায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকারের বিরুদ্ধে এক মাছ ব্যবসায়ীকে লাথি মারার অভিযোগ ওঠে। এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মাছ ড্রেনে ফেলে দেন এ সরকারি কর্মকর্তা। ২০২০ সালের ১৩ মার্চ মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে নির্যাতনের নির্দেশ দিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন। এ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হলে তাকে ওএসডি করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে লঘু দণ্ড দেওয়ার পর দায়মুক্তিও দেওয়া হয়। ২০২০ সালে কারোনা মহামারিতে যশোরের মনিরামপুরে মাস্ক না পরায় তিন বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে সাজা দেন মনিরামপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান। সাজা দেওয়ার ঘটনাটি নিজের মোবাইল ফোনে ছবিও তোলেন তিনি। তিন বৃদ্ধকে কান ধরানো এবং তার ছবি তোলার মুহূর্তের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সামলোচনার ঝড় ওঠে। তার কয়েকদিন পর সিরাজগঞ্জের বেলকুচির ইউএনও সিফাত-ই-জাহান কর্তৃক পাঁচজনকে কান ধরিয়ে উঠবস করানোর ছবি স্থানীয়দের মাধ্যমে ফাঁস হয়।

গত বছরের ১৭ মে ফুলগাছ খাওয়ার অভিযোগ একটি ছাগলের ২ হাজার টাকা জরিমানা করেন বগুড়ার আদমদীঘির ইউএনও সীমা শারমিন। জরিমানা করার নয় দিন পর মালিক সাহারা বেগমকে না জানিয়ে সেটি বিক্রি করার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ২৭ মে জরিমানার টাকা ইউএনও নিজে ফেরত দিয়ে ছাগলটিকে সাহারা বেগমের কাছে ফিরিয়ে দেন। একই বছরের ৮ জুলাই মানিকগঞ্জের সিংগাইরের ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘স্যার’ না বলে আপা বলায় ইউএনওর নির্দেশে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী তপন দাস জানান, খরিদ্দারের চাপের মুখে পড়ে লকডাউনের সময় দোকান খোলার অপরাধে ইউএনও তাকেসহ খরিদ্দারদের জরিমানা করেন। এ সময় তিনি স্যার না বলে ক্ষমা চাওয়ার সময় আপা বললে ইউএনও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ‘কেন আপা বললি’ বলেই পুলিশের লাঠি দিয়ে তার শরীরে আঘাত করতে থাকেন। একই বছরের ৪ অক্টোবর কুমিল্লার বুড়িচংয়ে জন্মনিবন্ধন-সংক্রান্ত কাজে ইউএনওর অফিসে যান প্রবীণ ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন। একপর্যায়ে ইউএনও সাবিনা ইয়াসমিনকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করলে ইউএনও উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘স্যার ডাকতে না পারলে মা ডাকবেন।’ ভুক্তভোগী জামাল উদ্দিন বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করলে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার বগুড়া সদরের ইউএনও সমর পালের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে লাঠি দিয়ে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। আলমগীর জানান, ‘ইউএনও তাকে ডেকে নিয়ে তার কক্ষে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন। এ সময় তাকে দুজন আনসার সদস্য ধরে রেখেছিলেন। তার বাম হাত ভেঙে গেছে।’ এর আগে গত ২১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু। এ ঘটনার একটি অডিও প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ঘটনার তিন দিন পর ওই ইউএনওকে ওএসডি করা হয়। সাংবাদিকের সঙ্গে ইউএনওর ভাষা ব্যবহারকে ‘মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি নোটিস জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ইউএনওকে হাইকোর্টে তলব করা হয়। গত বছরের ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করারও অভিযোগ ওঠে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানজনকভাবে নাম ধরে ডাকা, সরকারি ত্রাণের কম্বল দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশসহ ইউএনওর বিভিন্ন অশালীন আচরণের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে লালমনিরহাটের আদিতমারীর ইউএনও মুনসুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্থানীয় দুজনকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে নালা তৈরিতে আপত্তি জানালে ইউএনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার’ কথা জানানোর পাশাপাশি জমি খাস করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন বলে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগও জমা পড়ে। ওই বছরের মে মাসে নারায়ণগঞ্জে সরকারি হটলাইন ৩৩৩-এ কল করে ত্রাণ চাওয়ার পরে জরিমানার মুখে পড়েছিলেন একজন সাহায্যপ্রার্থী। দরিদ্র না হয়েও ত্রাণ চেয়েছেন এমন অভিযোগে ১০০ জন দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে হয় তাকে। এ নির্দেশ দিয়েছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা। এ ধরনের অসংখ্য নজির রয়েছে মাঠপ্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

আইন বিধি মেনেই দায়িত্ব পালন করতে হবে

জনগণের সেবক তা ভুলে গেছেন তারা

গুটিকয় কর্মকর্তার আচরণে সুনাম ক্ষুণ্ন

 

সর্বশেষ খবর