মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

সম্মেলনের পর ভোটের রাজনীতি

রফিকুল ইসলাম রনি

সম্মেলনের পর ভোটের রাজনীতি

আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগঠনে মনোযোগ দেবে আওয়ামী লীগ। এই তিন মাস কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলন, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণসহ মেয়াদোত্তীর্ণ ৩৩ জেলার সম্মেলন সম্পন্ন করবে ক্ষমতাসীন দলটি। এর পর আগামী জানুয়ারি থেকে মনোযোগী হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট নিয়ে। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে বছরব্যাপী দেশ-বিদেশে সরকারের ইতিবাচক অর্জনগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাবেন নেতারা।   

আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে বিএনপি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠন, আন্দোলন করার দৌড়ে থাকলেও তা আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য দলকে সুসংগঠিত করা। সেজন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্মেলন শেষ করতে চায় দলীয় হাইকমান্ড। 

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক, জোট গঠনের তৎপর হলেও সেটাকে আমরা আমলে নিচ্ছি না। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাসী। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন-ধারণকারী রাজনৈতিক কিছু দলের সঙ্গে আমরা জোটে আছি। কাজেই নতুন করে জোট গঠন নিয়ে আমাদের কোনো তৎপরতা চালানোর দরকার নেই।’ তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমরা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল এবং দলের সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত। সম্মেলন শেষ করার পর নতুন উদ্যমে ভোট নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করব।’ দলীয় সূত্রমতে, চলতি সপ্তাহে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডাকা হতে পারে। সেই বৈঠক থেকে দলের কেন্দ্রীয়, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম এবং ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হতে পারে। চলতি অক্টোবর থেকে আগামী ডিসেম্বরকে সাংগঠনিক মাস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ সংগঠনে মনোযোগী হবে।

দলের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনের ব্যাপারে আজকেও গণভবন থেকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আজ বিকাল ৪টায় গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড ও সংসদীয় বোর্ডের যৌর্থ সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার পাশাপাশি বেশকিছু উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এই বৈঠকেও দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করতে পারেন। ইতোমধ্যে সম্মেলনের তারিখ চেয়ে দলীয় সভানেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ।

দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্রলীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতাদের কর্মকান্ডেও সন্তুষ্ট নন বঙ্গবন্ধুকন্যা। গ্রুপিং ও পদ-বাণিজ্যে জর্জরিত এই সংগঠনের নেতাদের হুঁশিয়ারি দেওয়ার পাশাপাশি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব আনার তাগিদ আসতে পারে আজ।

মহিলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৭ সালের ৪ মার্চ। তিন বছর মেয়াদি এই কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ৪ মার্চ। একই বছর ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় যুব মহিলা লীগের সম্মেলন। তাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ১১ মার্চ। তেমনি তাঁতী লীগের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। ওই বছরের জুলাইয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও গোলাম রাব্বানী। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবিসহ নানা অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পদ হারান দুজন। তাদের স্থলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যকে। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আল নাহিয়ান খান ও লেখক ভট্টাচার্যকে ভারমুক্ত করা হয়। জয়-লেখক প্রায় তিন বছর ধরে সংগঠনের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ছাত্রলীগের কর্মকান্ড আওয়ামী লীগকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে তৃণমূল অর্থাৎ জেলা-উপজেলা-থানা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ের সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটিগুলোকে হালনাগাদ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। জেলা-উপজেলায় পুরোদমে সম্মেলন শুরু হয়েছে। সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনেরও সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। তবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ভোট নিয়ে ভাবছে না। সংগঠনকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করার কাজ চলছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে কোনো রাষ্ট্রনায়ক একটি ভোট শেষ হলে আরেকটি ভোট নিয়ে ভাবেন। কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ভোট নিয়ে ভাবেন না। তিনি পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে ভাবেন। তিনি সংগঠনকে নিয়ে ভাবেন। আমরা আপাতত সংগঠনকে নিয়ে ভাবছি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয়, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন, জেলা ও মহানগরের সম্মেলন শেষ করা হবে। ‘ভোট উপযুক্ত’ নেতৃত্ব বাছাইয়ের মাধ্যমে পরবর্তীতে আমরা নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামব।’

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, আগামী জানুয়ারি থেকে ভোটের জন্য মাঠে নামবে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী প্রচারযুদ্ধে নিজেদের উন্নয়ন এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতিবাচক কর্মকান্ডকে প্রাধান্য দিবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। জোরালো প্রচার-প্রচারণা নিশ্চিত করতে ঠিক করা হয়েছে নির্বাচনী প্রচার কৌশল। ভোটারদের কাছে টানতে গত ১৩ বছরের বিভিন্ন উন্নয়ন বেশি বেশি প্রচার করবে আওয়ামী লীগ। মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোসহ বাস্তবায়ন হওয়া বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টসহ পদ্মা সেতু, রাজধানীতে মেট্রোরেল, রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল, এলএনজি টার্মিনাল, বিভিন্ন রুটে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, পায়রা বন্দরসহ বিভিন্ন মেগাপ্রজেক্টের কথা তুলে ধরবে আওয়ামী লীগ।

ভবিষ্যতে রাজধানীর সঙ্গে বুলেট ট্রেন সংযোগ, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রেল সংযোগ স্থাপন, দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, দ্বিতীয় যমুনা সেতু, দ্বিতীয় স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। এগুলো নির্বাচনী ইশতেহারেও থাকবে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম বৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুখ্যাতি ও প্রভাব, রোহিঙ্গা ইস্যু, সমুদ্রসীমা, সীমান্ত সমস্যা সমাধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সফলতাও তুলে ধরবে আওয়ামী লীগ। উন্নয়ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গত নির্বাচনের ইশতেহারের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে সেগুলোর বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরা হবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪১ সালের উন্নত দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি ২১০০ সালের বাংলাদেশ কেমন তা নিয়ে শত বছর মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যানের কথাও ইশতেহারে তুলে ধরবে আওয়ামী লীগ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনের সরকারের সফলতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রাখা, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি বিগত সময়ে এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতার কথা তুলে ধরা হবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার যুদ্ধে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আমলের বিভিন্ন উন্নয়ন তুলে ধরার পাশাপাশি বিএনপি আমলের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হবে। বিএনপি আমলের দুর্নীতি, হাওয়া ভবন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্রও তুলে ধরবে আওয়ামী লীগ। এসবের সঙ্গে প্রাধান্য পাবে বিগত সময়ে বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন আন্দোলনের সময়কার সহিংসতার কথা, বিশেষ করে ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন এবং ২০১৪ সালে সরকার উৎখাতের ৯২ দিনের টানা আন্দোলনের সময়কার সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাসের কথাও তুলে ধরবে আওয়ামী লীগ।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় সম্মেলনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। বর্ধিত সভা, প্রতিনিধি সভা, বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে নানা ধরনের সভা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই, স্ব স্ব জেলার সম্মেলন শেষ করা। এ ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। চলতি সপ্তাহেই সম্মেলনের তারিখগুলো জানা যেতে পারে।’

সর্বশেষ খবর