বুধবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

শেষ নেই চাঁদাবাজির

সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম

শেষ নেই চাঁদাবাজির

ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির শেষ নেই। পরিবহন সেক্টর, নির্মাণ খাত, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ফুটপাত কিংবা আইনি সহায়তা- চাহিদামতো বখরা না দিলে যেন মিলছে না কাক্সিক্ষত কোনো কিছুই। রাজধানী থেকে মফস্বল শহর, ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে গেলেই বিভিন্ন ছাত্র-যুব সংগঠনকে দিতে হচ্ছে অর্থ। অপারগতা ব্যক্ত করলেই দাবি ওঠে ইট, বালু, সিমেন্ট সাপ্লাইয়ের। শান্তিতে নেই সরকারি কাজের ঠিকাদাররাও। কাজ নিতে ও বাস্তবায়ন করতে তাদের গুনতে হচ্ছে ২ থেকে ২০ শতাংশ কমিশন। না দিলে মিলছে না কাজ। আবার মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয় অর্থের সরবরাহ। এর বাইরে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়ে গেছে নামে-বেনামে ব্ল্যাকমেলিং। বেড়ে গেছে উৎসবকেন্দ্রিক চাঁদা। উৎসবকেন্দ্রিক চাঁদায় রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী থেকে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। না দিলেই শুরু হয় নানা হয়রানি।

সংশ্লিষ্টরা             বলছেন, গার্মেন্টসে ঝুট ব্যবসার নামে এক ধরনের অর্থ আদায়ের হুমকি থাকে বারো মাস। অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না। নানা কারণে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরও দিতে হয় অর্থ। এসব বিষয়ে অনেকে র‌্যাব-পুলিশে লিখিত ও মৌখিক প্রতিদিনই অভিযোগ করে চলেছেন। আবার দখলবাজি নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় মানুষকে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে জায়গাজমি দখলের অভিযোগও বাড়ছে। এমনই কিছু কেসস্টাডি তুলে ধরা হলো- ঘটনা-১ : শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাসকে তার চাহিদামতো চাঁদা না দেওয়ায় হুমকির মধ্যে পড়েছেন মিরপুরের এক নারী ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠান এজি ফ্যাশন গার্মেন্টস রীতিমতো বন্ধ হওয়ার উপক্রম বলে জানিয়েছেন হেলেনা বেগম। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেছেন, আব্বাস বাহিনীর সদস্যরা তার কাছে থেকে বহুবার চাঁদা নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি তারা মোটা অঙ্কের চাঁদা না দিলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। তাদের কবল থেকে বাঁচতে শহীদ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে তিনি ব্যবসার সাব-কন্ট্রাক্ট দেন। কিন্তু আব্বাস বাহিনীর সঙ্গে মিশে গিয়ে শহীদ তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছেন। ঘটনা-২ : একসময়ের লালবাগ থানা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা আনোয়ার হোসেন আনুু। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উঠেপড়ে লাগেন দখল আর চাঁদাবাজিতে। আজিমপুরে কবরস্থান-সংলগ্ন ইরাকি মাঠ ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেখানে বাজার বসিয়ে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এর বাইরে এলাকাভিত্তিক কোনো ভবন নির্মাণ করতে গেলে তার সঙ্গে রফাদফার পরই নির্মাণকাজে হাত দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনা-৩ : ১৭ আগস্ট চাঁদা না পেয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের দক্ষিণ সোনাইছড়ি এলাকায় একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ট্রাক পার্কিংয়ের রাস্তায় বাঁশের খুঁটি দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয় সন্ত্রাসীরা। পরে এ ঘটনায় জমির মালিক চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য নুরুল আলম চৌধুরী থানায় অভিযোগ দেন। অভিযোগসূত্রে জানা গেছে, জুনে ইস্পাহানি সামিট অ্যালায়েন্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান নুরুল আলম চৌধুরীর কাছ থেকে ওই জমি ভাড়া নিয়ে কাভার্ড ভ্যান পার্কিংয়ের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। এতে জমির মালিক নুরুল আলম চৌধুরীর কাছে চাঁদা দাবি করেছিল স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। ওপরের তিনটি ঘটনার মতো দেশজুড়ে প্রতিদিনই ঘটছে নানা ঘটনা। পরিবহন, ফুটপাত, মার্কেট, ক্ষুদ্র কিংবা ভাসমান ব্যবসায়ী- কারোরই যেন রেহাই নেই চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য থেকে। ভুক্তভোগীরা নীরবেই পূরণ করে যাচ্ছেন চাঁদাবাজদের চাহিদা। তারা বলছেন, পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়াই তাদের শঙ্কার কারণ। নিজের কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অতীতের মতো এখনো হয়তো তারা নীরব থাকবেন। এলিট ফোর্স র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে দিন। সে যে-ই হোক, তদন্তে সত্যতা পেলে র‌্যাব তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। অপরাধীকে আমরা অপরাধী হিসেবেই দেখি। জনগণের জানমাল রক্ষায় সর্বোচ্চটা দিতে র‌্যাবের প্রতিটি সদস্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চাঁদাবাজির বিষয়ে পুলিশ সব সময়ই জিরো টলারেন্স নীতিতে। পুলিশ সদর দফতর থেকে সব ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া আছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার। এর পরও কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বিষয়ে তদন্ত করবে।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। অলিগলিতে এর চলাচল বেশি থাকলেও এসব রিকশা সুযোগ পেলে মূল সড়কও দাপিয়ে বেড়ায়। আর এসব রিকশা থেকে চাঁদা নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীরা। মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে এসব রিকশা চলাচল করছে। যেসব রিকশার মালিক চাঁদা দেন, তাদের বিশেষ স্টিকার দেওয়া হয়। সেই স্টিকার দেখলে কোনো ট্রাফিক পুলিশ সদস্য রিকশা আটকান না। অন্যদিকে স্টিকার না থাকলে লাগানো হয় রেকার, পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডাম্পিং স্টেশনে। জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে ৩ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। সবই অবৈধ। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাসোহারা দিয়ে এগুলো দাপটের সঙ্গে চলছে। অবৈধভাবে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা থেকে মাসিক ৩০-৩৫ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীর ফুটপাতে ব্যবসা করছেন ৩ লাখ হকার। সেখান থেকে বছরে চাঁদা উঠছে ২ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ফুটপাতে বসতে একজন হকারকে এলাকাভেদে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত লাইনম্যানদের চাঁদা দিতে হয়। দৈনিক গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হলেও এর পরিমাণ বছরে দাঁড়ায় ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। এর পুরোটাই চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজ ও নিয়ন্ত্রকদের পকেটে। হকাররা দিন এনে দিন খেতে না পারলেও এদের কাছ থেকে তোলা চাঁদার টাকায় আয়েশি জীবন যাপন করছে চাঁদাবাজ ও নিয়ন্ত্রকরা। তাদের কাছে রাজধানীর ফুটপাত যেন টাকা বানানোর মেশিন। আবার রাজধানীকেন্দ্রিক বিভিন্ন চাঁদাবাজ গ্রুপের নেপথ্য মদদদাতা বিদেশে আত্মগোপনকারী শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। ওঠানো চাঁদার একটি বড় অংশ তাদের কাছে পৌঁছে যায়। গত ১০ বছরে রাজধানীতে চাঁদা দাবি করে ফাঁকা গুলির ঘটনা ঘটেছে শতাধিক।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর