বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ ইয়াহিয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ ইয়াহিয়ার

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালি। একে একে শেষ হয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সব আশা-ভরসা। উপর্যুপরি হামলায় নাস্তানাবুদ দখলদার বাহিনী। সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ এগিয়ে এলে পাকিস্তানকে সহায়তা করতে আসা মার্কিন সপ্তম নৌবহর পথ পরিবর্তন করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ওঠে। রেগে জাতিসংঘকে ধোঁকাবাজির পীঠস্থান আখ্যায়িত করে অধিবেশন থেকে সদলবলে বেরিয়ে যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। গভীর রাতে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন নিয়াজি। একাত্তরের এই দিনে গাজীপুর, খাগড়াছড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লার ময়নামতী, খুলনার বিভিন্ন এলাকা, বগুড়া ক্যান্টনমেন্টসহ দেশের অনেক এলাকা যৌথবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এদিন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক ইউনিট। আশপাশের শহরগুলো শত্রুমুক্ত করার পর যৌথবাহিনী ঘিরে ফেলে রাজধানী ঢাকাকে। হানাদার বাহিনীর সর্বশেষ অবস্থান ঢাকা জয় তখন মূল লক্ষ্য।

১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পোল্যান্ডের দেওয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। পোল্যান্ড বাংলাদেশের পাকিস্তানি বাহিনীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেয়। জবাবে ভুট্টো বলেন, ‘আমি সারেন্ডার ডকুমেন্ট নিয়ে ফিরতে চাই না। নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। চার দিন ধরে আমরা এখানে কথা বলছি। আর তারা কেবল ঢাকায় আত্মসমর্পণের প্রস্তাব তুলছে। কিন্তু কেন? আমরা কী করব বা নিরাপত্তা কীভাবে ফিরে আসবে, আমাদের এখানে এসে তা বলার কথা ছিল। কিন্তু এ প্রসঙ্গে সবাই চুপ।’ ভুট্টো তার বক্তব্যের শেষ প্রান্তে এসে প্রস্তাবের কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করছি? আমি যাচ্ছি। জাতিসংঘে এটাই আমার শেষ আসা।’ তিনি জাতিসংঘকে ধোঁকাবাজির পীঠস্থান আখ্যায়িত করে অধিবেশন থেকে সদলবলে ওয়াকআউট করে বেরিয়ে যান।

এদিকে মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে মোকাবিলা করতে এদিন বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এরপর মার্কিন রণতরীর সপ্তম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। এতে পাকিস্তানের মনে যুদ্ধে সাহায্য পাওয়ার শেষ আশাটুকুও ফুরিয়ে যায়।

১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির আবেদন জানান। এ সময় ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ সন্ধ্যা ৫টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, ‘পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে কি না, তা জানানোর জন্য বিশেষ বেতার কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কোড নম্বর দেওয়া হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করা হলে ফের বিমান হামলা শুরু হবে। ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে।’

পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ না করায় যৌথবাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা করে। গভীর রাতে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দেন, ‘ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেওয়া যেতে পারে।’ আত্মসমর্পণের এ নির্দেশ পেয়ে সেনানিবাসে নিজের কক্ষে কান্নায় ভেঙে পড়েন জেনারেল নিয়াজি। পরে রাত ২টার মধ্যে বাংলাদেশের সব জায়গায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তারবার্তা পাঠিয়ে দেন।

সর্বশেষ খবর