শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা মানব পাচারে

প্রতিদিন ডেস্ক

উৎকণ্ঠা মানব পাচারে

বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ঘটনা উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, মানব পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে খুলনাসহ সুন্দরবন অঞ্চল থেকে। এর পরেই রয়েছে ঢাকা এবং সিলেট অঞ্চল। জাতিসংঘ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষের চরম দরিদ্র হওয়ার ঘটনাকে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। এতে করে সহজেই তারা অসহায়দের প্রলুব্ধ করতে পারছে।

গতকাল সকালে ইউএনওডিসির মানব পাচারবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন ঢাকায় প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) রাজধানীর একটি হোটেলে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে।

সভায় প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করা হয়। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার বৈশ্বিক এই প্রতিবেদনটি ভিয়েনা থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। এটি নিয়েই এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ঢাকার আলোচনায় ‘বাংলাদেশে সাইক্লোন ও ঘূর্ণিঝড়’ শিরোনামে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদন স্থান পায়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘের সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন অঞ্চল থেকে বেশি মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের এ বন অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিপর্যয়ের হটস্পট। সুন্দরবনে কিছুদিন পরপর বন্যা ও সাইক্লোনের কারণে ফসল ও সম্পদের ক্ষতি হয়। এ অঞ্চলের ৪৩ শতাংশ মানুষ ২০১৪ সাল থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। ঋণে জর্জরিত এ অঞ্চলের মানুষকে অনেক সময় মৎস্য শিল্পে ও কারখানাগুলোতে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে শিশুদেরও শ্রমে যুক্ত করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মানব পাচারকারীদের সুযোগ করে দিয়েছে।

ঋণগ্রস্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে তারা পাচার করে। পাচারকারীরা বড় অভিযান চালায় খুলনাসহ এ অঞ্চলকে ঘিরে। এ অঞ্চলের মানব পাচারকারীরা আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সঙ্গে মিলে কার্যক্রম পরিচালনা করে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা যখন উন্নত জীবনের খোঁজে ঢাকা অথবা কলকাতায় আশ্রয় নেয়, তখনো তারা পাচারকারী এজেন্টদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং শোষণের শিকার হয়। প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে ৪ লাখ মানুষের বাস্তচ্যুত হওয়া এবং শিশুদের চরমপন্থি দলের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয় তুলে ধরা হলেও রোহিঙ্গা নিয়ে একটি শব্দও লেখা হয়নি। তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সম্প্রতি দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সাড়ে ৩ হাজার রোহিঙ্গা সাগর পার হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। এমন ভয়াবহ যাত্রায় ৩৪৮ জনের বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে অথবা হারিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের পর এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশ বা মিয়ানমার থেকে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করে। সমুদ্রপথে ভয়াবহ এমন যাত্রার ব্যবস্থা করে মানব পাচারকারীরা।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরে নারী এবং মেয়েশিশুরা পাচার ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। পাচার ও নিপীড়নের শিকার এসব নারী এবং শিশুদের মধ্যে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফরম টিকটক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁদে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। মানব পাচারকারী শুধু যৌন নিপীড়ন নয়, মানব দেহের অঙ্গ পাচারেও যুক্ত বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও কভিড-১৯-এর পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মন্দায় হতদরিদ্ররা মানব পাচারের ঝুঁকিতে আছেন।

ভিয়েনাভিত্তিক জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধবিষয়ক সংস্থার (ইউএনওডিসি) ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনকে মানব পাচারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে মানব পাচার বেড়ে যাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব আমিনুল ইসলাম খান বলেন, মানব পাচার একটি আন্তসীমান্ত সমস্যা। তাই এ ধরনের জটিল সংকটের সমাধানের জন্য সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। বিশেষ করে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা তাদের অপরাধের ধারায় পরিবর্তন এনেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে মানব পাচারকারীরা লোকজনকে প্রলোভনে ফেলে ফাঁদে জড়িয়ে ফেলছেন। তাই মানব পাচার প্রতিহত করতে হলে আইন, বিধিসহ নানা ধরনের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। আলোচনায় ইউএনওডিসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিনিধি মার্কো টেক্সেরিয়া বলেন, ‘অনলাইনে মানব পাচারের নিয়োগ এবং সাইবার অপরাধের মাধ্যমে মানব পাচারের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে। করোনা মহামারিতে এই পরিস্থিতি বেড়েছে। যেখানে মানব পাচারকারীরা আরও প্রযুক্তি-সচেতন হয়ে উঠছেন। তবে সফলভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা মানব পাচারকারীদের শনাক্ত, তদন্ত এবং বিচার করতে পারি।’ বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৪১টি দেশের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে মানব পাচারবিষয়ক এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে ইউএনওডিসি। প্রতিবেদন তৈরিতে বিভিন্ন দেশের আদালতের মানব পাচারসংক্রান্ত ৮০০টি মামলার বিশ্লেষণকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। অভিন্ন এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোথায় কোথায় নজর দেওয়া দরকার, তা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে করোনা মহামারি মানব পাচারের ঝুঁকি কীভাবে বাড়িয়েছে, সেটা উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি মানব পাচারের মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে আইওএমের প্রধান আবদুস সাত্তার ইসভ বলেন, অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও নারী ও শিশুর পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত মানুষ মানব পাচারের ঝুঁকিতে আছেন। কভিড-১৯ মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। মানব পাচার দমনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এবং নাগরিক সমাজকে যুক্ত করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খায়রুল আলম শেখের সভাপতিত্বে আলোচনায় বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (জাতিসংঘ অনু বিভাগ) তৌফিক ইসলাম শাতিল, ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন দূতাবাসের উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগের প্রধান মরিজিও সিয়ান, কানাডা হাইকমিশনের রাজনৈতিক কাউন্সেলর ব্র্যাডলি কোটস, ইউএনওডিসি সদর দফতরের কর্মকর্তা এইমি কোমরিয়ে এবং এডুরিস মারকুয়েজ ও ইউএনওডিসি বাংলাদেশের জাতীয় কর্মসূচি সমন্বয়কারী মেহেদি হাসান।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর