বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

৬০ শতাংশ বেশি দামে কয়লা বিক্রি করতে চায় আদানি

আলোচনা করতে আসছে প্রতিনিধি দল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভারতের আদানি গ্রুপ দেশটির ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা থেকে যে বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করতে যাচ্ছে তার জন্য কয়লার দাম দেড় গুণ বেশি ধরতে চাচ্ছে। আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম ধরতে চায় ৪০০ ডলার। তারা এই দরে কয়লা আমদানির ঋণপত্র খোলার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। অথচ বাংলাদেশের রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার দাম পড়ছে প্রতি টন ২৫০ ডলারের মতো। ফলে আদানি প্রতি টন কয়লার যে দাম প্রস্তাব করেছে তা রামপাল ও পায়রার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। আর আদানি কয়লার দাম বেশি ধরলে বাংলাদেশকে অনেকটা বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আদানি গ্রুপ শুরু থেকেই গোড্ডা কেন্দ্রের কয়লার দাম নিয়ে কারসাজি শুরু করে। জাহাজ ভাড়াসহ গোড্ডায় ব্যবহৃত কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ২০০ ডলার, আর আদানি পিডিবির কাছে ৪০০ ডলারে বিক্রির জন্য চিঠি দিয়েছে। এতে প্রকৃত দাম থেকে কারসাজি করে টনপ্রতি ২০০ ডলার বাড়তি নিতে চায় আদানি গ্রুপ।

এরই মধ্যে আদানির প্রস্তাব করা কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পিডিবি। দর নিয়ে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি দল পাঠাতে গত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে আদানিকে চিঠিও দিয়েছে পিডিবি। সে অনুযায়ী আদানির একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল আলোচনা করতে ঢাকায় আসবে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আদানি কয়লার দাম পুনর্মূল্যায়নে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত জানুয়ারি মাসের প্রথমে যখন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ঝাড়খণ্ডে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তখন এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে আদানি গ্রুপ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। এরপর আমরা লিখিতভাবে তাদের কয়লার দাম কমানোর বিষয়ে বলেছি। তারা এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। চলতি মাসের ২২ বা ২৩ তারিখে আদানির প্রতিনিধি দল আলোচনার জন্য বাংলাদেশে আসতে পারে। তখন এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। আদানি যে দেশ থেকেই কয়লা আমদানি করুক সেই ইনডেক্সের মধ্যে আমাদের যাতে ছাড় দেয় সে বিষয়টি আমরা জানিয়েছি। প্রসঙ্গত, আদানি ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তির পর আদানি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। এতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আগামী ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ। আগামী মার্চ মাসে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার কথা রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর আগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লার দাম কমিয়ে নিতে চায় বিদ্যুৎ বিভাগ। এটি নিয়ে এ জন্য দুশ্চিন্তায় আছে পিডিবি।

আদানিকে দেওয়া পিডিবির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যে দামে কয়লা কেনা হচ্ছে সে দামেই আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা কিনতে হবে। এ দুটি কেন্দ্রের চেয়ে বাড়তি দামে কয়লা কেনা যাবে না। জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় আদানির মালিকানাধীন কারমাইকেল কয়লা খনি থেকে আমদানি করা কয়লা দিয়ে গোড্ডার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালানো হতে পারে। নিউক্যাসেল বন্দরে সাড়ে ৫ হাজার কিলোক্যালরির অস্ট্রেলিয়ান কয়লার প্রতি কেজির দাম গত ২৭ জানুয়ারি ১২৯ দশমিক ৮৭ ডলারে নেমে গেছে। পণ্যমূল্য নিয়ে কাজ করা এজেন্সি আর্গাস থেকে এই তথ্য জানা গেছে। গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৪ হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির কম মানের কয়লায় চলবে। এ জন্য এই দাম আরও কম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বর্তমানে পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার জন্য প্রতি মেট্রিক টনে ২৪৫ ডলার, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২৫৪ দশমিক ৩৪ ডলার এবং বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২৭০ ডলার দিচ্ছে পিডিবি।

সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশ আদানির বিদ্যুৎ পাবে। বিদ্যুতের দাম চুক্তিতে যা ছিল সেটিই থাকবে। দাম ওঠানামা করবে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামের ওপর। তিনি বলেন, কয়লার প্রাইসিং হয় বিভিন্ন ধরনের ইনডেক্স অনুযায়ী। আমাদের সঙ্গে আদানির যে চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী ওই ইনডেক্স থেকেই দাম নির্ধারণ করা হবে। আমরা কমপিটিটিভ প্রাইসে কয়লা পাব। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনায় আদানির সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করা হয়েছে (২০১৭ সালে)। সে সময় দেশে আমদানি করা কয়লানির্ভর কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়নি। এ জন্য কয়লার দামের বিষয়টি নিয়ে সে সময় পিডিবি ভালো করে যাচাই-বাছাই করেনি। আদানির নিজস্ব কয়লা খনি ও ভারতের বড় একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করতে হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে পায়রা এবং গত মাসে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এতে কয়লা আমদানির বিষয়ে পিডিবির ধারণা হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন করছেন, আদানির কয়লায় বিদ্যুতের দাম সাশ্রয়ী হবে কি না- কয়লার দামের বিষয়টি চুক্তি সইয়ের আগে ভালো করে দেখা উচিত ছিল। কয়লার দাম বেশি হলে পিডিবি বিদ্যুৎ না নিলেও আদানিকে কেন্দ্র ভাড়া পরিশোধ করতে হবে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র্রভিত্তিক পুঁজিবাজারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ আদানির শেয়ারবাজারে কারসাজি এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতির বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে আদানি গ্রুপের সম্পদের মূল্য প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। এ সময় আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির বাজার মূলধন ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি কমেছে। হিনডেনবার্গের অভিযোগ, আদানি গোষ্ঠী জালিয়াতি করে শেয়ারের দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে গিয়ে আদানি গ্রুপ শেয়ারবাজারের মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি কয়লার অতিমূল্যায়ন করা শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই আদানি গ্রুপকে ঠেকানো না গেলে বড় বিপর্যয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর