বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

আগামী নির্বাচনে আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের

অবাধ নিরপেক্ষতার আশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর, ডেরেক শোলের বৈঠক

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

আগামী নির্বাচনে আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক শোলে -পিআইডি

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে গতকাল ঢাকায় দিনভর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচন নিয়েও গুরুত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ কর্মকর্তা। তিনি সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কখনই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না। অন্যদিকে ডেরেক শোলে সাংবাদিকদের বলে গেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। এ জন্য আমি বাংলাদেশে এসেছি। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্যস্ত সময় কাটিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেছেন ডেরেক শোলে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা আসা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে গতকাল সকালে একটি হোটেলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে প্রাতঃরাশ বৈঠকের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু করেন। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা এ বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আলোচনা হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের ইস্যুটি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয় শোলের পক্ষ থেকে। এ ছাড়াও সামরিক চুক্তি, মানবাধিকার নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গণভবনে যান শোলে।

সৌজন্য সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেরেক শোলেকে বলেছেন, আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। আমি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। আমি কখনই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না। আগামী সাধারণ নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে তাঁর দল দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ভিত্তি নেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জন্ম হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। সামাজিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়নের বিষয়ে আলোকপাত করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের আমলে বিগত ১৪ বছরে বাংলাদেশের এই পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়েছে। দেশে অব্যাহত গণতান্ত্রিক চর্চা ও স্থিতিশীলতার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। আলোচনায় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও রোহিঙ্গা ইস্যুও স্থান পায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের উচিত এই যুদ্ধ বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়া। আলোচনার মাধ্যমে এই বিরোধের মীমাংসা হতে পারে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হিসেবে দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এবং মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক নাগরিক আসার কারণে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের এই বাস্তুচ্যুত নাগরিকরা পাঁচ বছর ধরে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের কারণে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ও স্থানীয়দের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে। আর তাই এখন তাদের সেখানে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় ডেরেক শোলে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের জন্য তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। মিয়ানমারে আবার কোনো গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন ডেরেক শোলে। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন ড. মোমেন ও ডেরেক শোলে। এ সময় ডেরেক শোলে বলেন, ৫১ বছরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়ে আমরা আশাবাদী। একটি খুব দৃঢ় অংশীদারিত্বের ৫১ বছর পার হয়েছে। আমরা আগামী ৫১ বছর এবং তারপরও একসঙ্গে কাজ করছে চাই। অভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আমাদের একই রকমের অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। ডেরেক শোলে বলেন, অনেক মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশে সফর করেছেন এবং আমি এখন এসেছি এটি বার্তা দেয় যে আমরা এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিই এবং সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সাহায্য করতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত কাজ করছে। এ সমস্যার মূল উৎস মিয়ানমারে।

এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমাদের সাহায্য করেছে এবং করে যাচ্ছে। তারা আমাদের সঙ্গে একমত যে, রোহিঙ্গাদের জীবনমানের উন্নয়ন করতে হবে। তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। তাদের হৃদয়ে একটা আশা দিতে হবে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আমাদের আলোচনা খুব ভালো হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, তিনি (ডেরেক এইচ শোলে) এসেছেন আমাদের দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ভালো করার জন্য, আরও শক্তিশালী করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো, আমরা এই সম্পর্ককে আরও অনেক সামনে নিয়ে যেতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। আমি খুব খুশি যে ডেরেক একা আসেননি, তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অনেককে নিয়ে এসেছেন। এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্য।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে মধ্যাহ্নভোজ ও মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে আরও কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে গত সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন ডেরেক শোলের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। তার নেতৃত্বে এই প্রতিনিধি দলের কয়েকজন সদস্য অগ্রগামী দল হিসেবে গত রবিবার বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ঘুরে দেখে। তারাও গতকাল ডেরেক শোলের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করেন।

সফর ফলপ্রসূ বললেন শোলে : সফর নিয়ে গত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকগুলোতে কাউন্সেলর শোলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকারের সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে সহযোগিতা ও একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। কাউন্সেলর শোলে বলেন, বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির পর পরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসে আমি সম্মানিত বোধ করছি। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব রয়েছে, যা কয়েক দশকের সহযোগিতা ও সমর্থনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের উভয় দেশের জন্য আরও বেশি স্থিতিশীল, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা ও মানবিক সহযোগিতার পূর্ণ সম্প্রসারণের পাশাপাশি দুই দেশের জনগণের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলার জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে চলেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর