শিরোনাম
বুধবার, ১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভারতের জি২০ এজেন্ডায় বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা

ভারতের জি২০ এজেন্ডায় বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি

বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সংগঠন জি২০-এর সভাপতি হিসেবে ভারতের শুরুটা ভালো। ২০টি স্থানে প্রায় ৩০টি বৈঠক হয়ে গেছে। বেঙ্গালুরুতে অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের প্রথম বৈঠক সফলভাবে হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রথম বৈঠকও শিগগির শুরু হবে। এসব বৈঠকে আলোচনার ফল আসন্ন সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে প্রভাব রাখবে।

২০০৮ সালে জি২০ বর্তমানের আকার নেয়। এটিকে দেখা হয় কার্যকর বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ (গভর্ন্যান্স) ফোরাম হিসেবে। একই সঙ্গে এ ফোরামকে দেখা হয় বিশ্ব অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে। বিদ্যমান গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ুগত জরুরি অবস্থার মতো বিভিন্ন সংকট ও সমসাময়িক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে যেখানে অসম অবস্থান দেখায়, সেখানে এই জি২০ ফোরাম বেশ প্রাসঙ্গিক। জি২০ নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার ১৫ বছর পার করেছে। এর মধ্যেই করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের মতো নানা ধ্বংসযজ্ঞের মুখে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে পুনরুজ্জীবিত ও টেকসই করার মতো কাজগুলো করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অব্যাহত মন্দার হুমকি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সংকট ও ব্যবসা-প্রযুক্তিতে প্রতিযোগিতা ফোরামের কাজকে জটিল করে তুলেছে।

মন্দার আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ। ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, ২০২১ সালের শেষে ঋণগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ ট্রিলিয়ন ডলারে। এটি বাড়তে থাকা সুদের হার এবং ধীরগতির বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে ঋণ সংকটের জন্য দায়ী করে। দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই উচ্চ ঋণ যন্ত্রণার ঝুঁকিতে বা ঋণ যন্ত্রণায় পড়েছে।

এটি নিশ্চিতভাবেই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিস্থাপক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি পরিস্থিতি তৈরি করে, যা ব্যবসায় চক্রের ধাক্কা, ভবিষ্যতের কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা, জলবায়ু সংকট ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করে। জি২০ সভাপতি হিসেবে ভারতের চোখ থাকবে কাঠামোগত রূপান্তর, বৃহত্তর প্রবৃদ্ধি, সমৃদ্ধি ও সাম্য আনার ওপর। এ ক্ষেত্রে বর্ধিত বাণিজ্য বৃদ্ধি হলো প্রধান উপাদান। মহামারিজনিত আঘাত সরবরাহশৃঙ্খলায় যে চাপ দেয় তাতে সুরক্ষাবাদের প্রসার ঘটে এবং উদ্ভূত বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। ইউক্রেন যুদ্ধ এ চাপকে তীব্র করে দেওয়ায় জ্বালানি, সার ও খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে এখন প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সংকেত যা স্বচ্ছ, ন্যায্য ও নিয়মভিত্তিক বাণিজ্যের অনুকূলে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতি জি২০-এর জোর সমর্থন এ বাণিজ্যের প্রধান চাবিকাঠি হতে পারে। ভারত বিশ্বাস করে, নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা বড় শক্তি, বড়-ছোট দেশের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহায়ক। বর্ধিত বাণিজ্যের ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, টেকসই উদ্ভাবন, কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের অগ্রগতি অর্জিত হবে। নয়াদিল্লিতে জি২০ সম্মেলন বড় একটি সুযোগ হতে পারে। এতে ভারত নিজেদের পাবলিক ডিজিটাল প্ল্যাটফরম প্রদর্শন করতে পারে, যা নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সরকারি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। পুরো বিশ্বের উপলব্ধি, ডিজিটাল প্রযুক্তি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এবং এ খাতে ক্ষমতায়নের চালিকাশক্তি। বিশ্বের এখন নতুন জ্ঞান-চালিত এবং উদ্ভাবনী পন্থা প্রয়োজন, যাতে জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের বিভিন্ন উপায় বাতলে দেয়।

ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধির আরেকটি উপাদান হলো বিশ্বের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এমএসএমই) বর্ধিত একীকরণ। বিশ্বব্যাংকের উপাত্তে দেখা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো জটিল ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। এসব প্রতিষ্ঠান ৯০ শতাংশ ব্যবসা চিত্রিত করে, যা বিশ্বজুড়ে ৫০ শতাংশ কর্মসংস্থানের জোগান দেয়। আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে কিছু অত্যাবশ্যকীয় উপাদান রয়েছে। গতিশীল বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এসব উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। যাই হোক, অর্থনীতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এসব উপাদানকে নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়, যা প্রবৃদ্ধি রোধ করে। সম্পদে প্রবেশের সঙ্গে এমএসএমইর চাহিদায় আরও গ্রহণযোগ্য তহবিলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনে ভারত সমর্থন দিয়ে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংশোধন বা পুনর্গঠন, গ্লোবাল সাউথের প্রয়োজনীয়তার প্রতি আরও সাড়াদান ভারতের সভাপতিত্বের আলোচনার শীর্ষে থাকবে। বাণিজ্যের মতো বিনিয়োগও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার একটি পূর্বশর্ত হলো একটি সহায়ক পরিবেশ, যা ব্যবসার পাশাপাশি কর্মীদের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি উইন-উইন (জয়-জয়) পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক বাস্তুসংস্থান তৈরি করে। মহামারি বিশ্বে অনেক মানুষের চাকরি কেড়ে নিয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভারতও কঠিন একটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। ফলত সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবিধি ২০২০ প্রণয়ন করেছে।

এটিকে শ্রম পুনর্গঠনের মৌলিক একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়েছিল, যাতে সব শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভারতের এ পদক্ষেপের বাস্তবায়ন অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ হতে পারে। শ্রমিকদের দক্ষ ও পুনর্দক্ষ করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের জন্য তাদের গড়ে তোলা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। কেননা ভারতসহ গোটা বিশ্বকেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে ক্রমবর্ধমান পারদর্শী কর্মশক্তির চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে, সার ও খাদ্যের মতো পণ্যের সরবরাহশৃঙ্খল কতটা ভঙ্গুর। এসবের সঙ্গে রয়েছে জলবায়ু সংকট। ইন্দোনেশিয়ার বালির জি২০ ঘোষণায় টেকসই ও স্থিতিস্থাপক কৃষি, খাদ্যব্যবস্থা ও সরবরাহশৃঙ্খলের দিকে একটি ত্বরান্বিত রূপান্তরের আহ্বান জানানো হয়েছে। খাদ্য ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুধা থেকে দুর্বলদের রক্ষা করতেও এ ঘোষণায় প্রতিশ্রুতি এসেছে। সভাপতিত্বের পুরো সময়ে ভারত চাইবে নিজেদের প্রতিশ্রুতি বাড়াতে। দেশটির সভাপতিত্বের মূলমন্ত্র- এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ। এ মূলমন্ত্রে ভারত মহামারির সময় আশপাশের দেশে খাদ্যশস্য পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছে। কৃষিতে জলবায়ু সংকটের ধাক্কার সঙ্গে মানিয়ে নিতে ভারত জলবায়ুসহিষ্ণু বিভিন্ন শস্যের জাত উদ্ভাবন করেছে। ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী জাতিসংঘ ২০২৩ সালকে ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব মিলেট হিসেবে ঘোষণা করেছে। কৃষকের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলো ভারত জি২০ প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে তুলে ধরতে পারে। ভারত জটিল এক সন্ধিক্ষণে জি২০-এর সভাপতিত্ব পেল। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত শাসন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য উদ্ভাবনী এবং সুদূরপ্রসারী কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে। একটিই আশা থাকবে, এই সময়ে দেশটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সমাধানে অবদান রাখার অবস্থানে থাকবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যকার সংযোগসেতু হিসেবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মঙ্গলের জন্য নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে ভারত প্রস্তুত।

লেখক : জি২০ সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়ক

সর্বশেষ খবর