শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

চার দিনে তিন বিস্ফোরণে রহস্য

মাহবুব মমতাজী

চার দিনে তিন বিস্ফোরণে রহস্য

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটেই চলেছে। গত এক সপ্তাহে এমন বিস্ফোরণ ঘটেছে অন্তত তিনটি। এখনো এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে এসব বিস্ফোরণের ঘটনা ঘিরে। ৪ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। পরদিন ঢাকার সায়েন্সল্যাবে ভবন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দেয়াল ধসে নিহত হন তিনজন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। রাজধানীতে এক দিন বাদেই গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে আরেকটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত এ ঘটনায় ২২ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহতের তথ্য পাওয়া গেছে। ৭ মার্চ বিকাল পৌনে ৫টার দিকে ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। এতে পাশাপাশি আরও দুটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগেও ২০১৯ সালে কিছুদিনের মধ্যে তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই বছর ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বিষাক্ত গ্যাস জমে একটি ম্যানহোলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মা-মেয়েসহ তিনজন আহত হন। এরপর ১০ ও ১১ জুন একই এলাকার শনির আখড়া ও মীরহাজিরবাগে বিস্ফোরণ ঘটে। এর রহস্য বের করতে কদমতলী থানা ও শ্যামপুর থানা পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগে জমা দেয়। এরপর ১৩ জুন ওয়ারী বিভাগের পক্ষ থেকে ডিএমপি কমিশনারের কাছে আরেকটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ওই সময় এসব প্রতিবেদন পাঠান ওয়ারী বিভাগের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপকমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কদমতলীর শনির আখড়ায় ও শ্যামপুরে পৃথক বিস্ফোরণে ফরিদ আহমেদ ও আবির হোসেন মিরাজ নামে দুজন নিহত হন। আহত হন অন্তত পাঁচজন। কদমতলীতে বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, ডেসা ও পুলিশ। অনুসন্ধানে ধারণা করা হয়, তিতাস গ্যাসের সাপ্লাই লাইনের লিকেজ থেকে নিঃসরিত গ্যাস স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে এক্সিম ব্যাংকের বাথরুম স্টোরে জমা হয়। এরপর এসি ও জেনারেটরের শর্টসার্কিট থেকে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলে তিতাস গ্যাসের লিকেজ এবং এক্সিম ব্যাংকের স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে সংযোগ পাওয়া যায়। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ দল মেশিনের মাধ্যমে এক্সিম ব্যাংকের বাথরুমে ৬০ ভাগ গ্যাসের উপস্থিতি পায়, যা পরে মেরামত করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শ্যামপুরের পাইপ রোডে বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল অনুসন্ধান করে জানা যায়, সেখানেও তিতাস গ্যাসের লাইনে লিকেজ পাওয়া গেছে। সেই লিকেজ থেকে নিঃসরিত গ্যাস ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ স্যুয়ারেজ লাইনে জমা ছিল। ওই স্যুয়ারেজ লাইনে আগে থেকে সৃষ্ট বায়োগ্যাস মজুদ ছিল। কিন্তু স্যুয়ারেজের পিঠে ওপর থেকে মজবুত করে কংক্রিটের ঢালাই থাকায় মজুদ গ্যাস বেরিয়ে যেতে পারেনি। ফলে উভয় গ্যাসের বিক্রিয়া ও চাপ এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেশি থাকায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। তিতাস গ্যাসের লাইনের অনিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এবং সিটি করপোরেশনের অনিয়মিত ব্যবস্থাপনার জন্যই এ বিস্ফোরণ ঘটে। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের পরও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস লাইনের ছিদ্র মেরামত না করায় বিস্ফোরণ হয়। জানা যায়, ওই প্রতিবেদনে গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে স্যুয়ারেজে ঝুঁকির কথা জানানোর পাশাপাশি তা প্রতিরোধে দ্রুত তিতাস গ্যাসকে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, দুর্ঘটনাগুলোর আগে গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস জমা হয়। মিথেন গ্যাস দাহ্য পদার্থ। বদ্ধ রুমে বাতাসে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ অথবা এর চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে কোনো স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ), ম্যাচের কাঠি বা আগুনের উৎস থাকলেই বিস্ফোরণ ও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় মিথেনের সঙ্গে যুক্ত হয় হাইড্রোজেন সালফায়েড, যা নিজে দাহ্য না হলেও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য হয়। মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফায়েড এক হয়ে বেড়ে যায় দাহ্যতা। সে কারণে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। এতে ভবনও ধসে যেতে পারে।

মঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তানে বিস্ফোরণে নিহত আরও একজনের লাশ গতকাল উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা   -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এদিকে মঙ্গলবারের ঘটনাটি সম্পর্কে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণের পরই সিদ্দিকবাজারের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। বেসমেন্ট ও গ্রাউন্ড ফ্লোর ধসে যায়, কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই এলাকার অন্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দের পর ভবন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। সাততলা ভবনটিতে বিস্ফোরণের পর আশপাশের ভবন ও যানবাহনে আঘাত করে। ভবনের সামনে অনেকে আহত হয়ে পড়ে ছিলেন। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। সেই সময় ভবনটি থেকে ইট-কাঠ ও জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে এসে পড়ে। এমনকি ভবনের নিচের একটা কলাপসিবল গেটও উড়ে সামনের লোকজনের গায়ে পড়ে। সেটার আঘাতেও অনেকে আহত হন। বিস্ফোরণে জিনিসপত্র উড়ে এসে সড়কের ওপরে থাকা একটি যাত্রীবাহী বাসের একপাশে আঘাত করলে জানালার সব কাচ ভেঙে যায় এবং যাত্রীদের অনেকে আহত হন। এ ছাড়া ভবনটির সামনে থাকা বেশ কয়েকটি ভ্যান ও রিকশার চালক এবং যাত্রীসহ অনেক পথচারী আহত হন। ভবনটির বেসমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে বেসমেন্টের ওপর পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, এই বিস্ফোরণের সঙ্গে তারা ২০২১ সালের জুনে মগবাজারের বিস্ফোরণের মিল দেখতে পাচ্ছেন। জানা গেছে, মগবাজারের বিস্ফোরণটি নিয়ে এখনো তদন্ত শেষ করতে পারেনি ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনা তদন্তের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটন করে জানায়, মসজিদের ভিতরে গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ছিল। গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হয়ে আসা গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, গত তিন বছরে গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ২ হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, স্যুয়ারেজ লাইনে বিস্ফোরণে ঝুঁকিতে তিতাস গ্যাসের যেমন দায় আছে, তেমনি সিটি করপোরেশনেরও দায় আছে। বছর তিনেক আগে রায়েরবাজারে একটি ব্যাংকের সামনে স্যুয়ারেজ লাইন বিস্ফোরণে দেয়াল পর্যন্ত উড়ে গিয়েছিল। সেখানে তিতাস গ্যাসের লিকেজের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। মগবাজারের বিস্ফোরণটিতেও তিতাস গ্যাস লাইনের লিকেজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তিতাস গ্যাসের ৫০-৬০ বছর আগের লাইন লিকেজ হয়েছে, কোনো মেরামত হয়নি, এরপর জমে থাকা মিথেন গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়। এমনকি ময়লা পানি থেকেও দাহ্য পাওয়া যায়। এখান থেকে তৈরি হওয়া গ্যাসেও বিস্ফোরণ ঘটে এবং মানুষ মারা যায়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে পরিদর্শন বাড়াতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সবাইকে সবার অবস্থান থেকে সচেতন থাকতে হবে। ২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকার একটি তিনতলা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের তোড়ে সেই ভবনের নিচতলার প্রায় পুরোটাই ধসে যায়। অনেকের শরীরে আগুন ধরে যায়। ওই দুর্ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। সে সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, হঠাৎ বিস্ফোরণের পর শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির কাচ, দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার হয়। ঘটনাস্থলের চারপাশে অন্তত এক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দ এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ঘটনায় ডিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, পাইপ লাইনের ছিদ্র (লিকেজ) দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। গ্যাস জমে জমে ভবনের ভিতরের কোনো কক্ষে ‘গ্যাস চেম্বার’ তৈরি হয়। এরপর কোনো সিগারেট বা অন্য কোনো মাধ্যমে আগুনের সংযোগে তা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এটি প্রাকৃতিক গ্যাস, মিথেন বা হাইড্রোকার্বন গ্যাসের বিস্ফোরণ।

সর্বশেষ খবর