সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

উত্তাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ভিসি অবরুদ্ধ, রেললাইনে আগুন, ট্রেন চলাচল বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ও রাবি প্রতিনিধি

উত্তাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও স্থানীয়দের হামলার প্রতিবাদে উত্তাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এ ঘটনায় ক্যাম্পাসে দফায় দফায় বিক্ষোভ, মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ ও উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচারসহ চার দফা দাবি জানানো হয়। এদিকে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশের নীরবতায় সংঘর্ষ দীর্ঘায়িত হয়েছে। এক পর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়।

এদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় নগরীর মতিহার থানায় মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মতিহার থানার ওসি হাফিজুর রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় মারধর, হামলা, গুরুতর জখমের অভিযোগ আনা হয়। তসলিম আলী ওরফে পিটার (৪৫) নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র রফিকুল আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক জানান, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় প্রশাসন কাজ করছে। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলা এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার প্রতিবাদে গতকাল সকালে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। মিছিল শেষে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন তারা। এ সময় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা একপেশে সংবাদ প্রচারের অভিযোগে চ্যানেল ২৪-এর সাংবাদিক ও সহকারীর ওপর হামলা চালান ও ক্যামেরা ভেঙে ফেলেন। সেখানে শহর ও ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের ওপরও চড়াও হন তারা। পরে দুপুরে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো ক্যাম্পাস। উপাচার্য উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে গেলে তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। এ সময় বিনোদপুর বাজারে গিয়ে এ ঘটনার সুরাহা করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। অনেকে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও স্থানীয়দের হামলার বিচার দাবি করেন। আবার কেউ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ তোলেন এবং প্রশাসনের পদত্যাগ দাবি করেন। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আন্দোলন করেন তারা। দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন উপাচার্য। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে বাসভবনে পাঠানো হয়। কিন্তু একদল শিক্ষার্থী আবার আন্দোলন শুরু করেন। তাদের কেউ উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান নেন এবং কেউ ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, তাদের ওপর হামলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। হামলাকারী পুলিশ ও স্থানীয়দের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে পদত্যাগ দাবি করেন তারা। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক বলেন, আমরা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি। অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য পুলিশ সজাগ দৃষ্টি রাখছে। তাছাড়া ক্যাম্পাসের বাইরের পরিবেশ শান্ত রয়েছে। এদিকে ক্যাম্পাসে এমন ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলারও অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রশাসন কর্তৃক আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় ও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের আর্থিক ব্যয়ভার বহন ও বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ১৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি আছেন। তারা সবাই শঙ্কামুক্ত। এদিকে বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মধ্যে উদ্ভূত  ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মর্মাহত। প্রশাসন সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা চায়। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব শিক্ষার্থীর সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক কাজ করছে প্রশাসন। এমনকি গত রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর এলাকাবাসী ও পুলিশের কতিপয় সদস্যের হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষ দাবি জানায়। এর আগে ১১ মার্চ সন্ধ্যায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মধ্যরাত পর্যন্ত দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হন শতাধিক শিক্ষার্থী। রাতে সংঘর্ষ চলাকালে বিনোদপুর বাজারে বেশ কিছু দোকান ও বিশ্ববিদ্যালয় গেটে পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাজার ও ক্যাম্পাসের বাইরে পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। এ ঘটনায় বিনোদপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম শহিদ জানান, শিক্ষার্থীরা ৩০টির বেশি দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে। এতে তাদের কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিনোদপুর বাজারে স্থানীয়দের সঙ্গে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষ পুলিশের ‘রহস্যময় নীরবতা’য় দীর্ঘায়িত হয় বলে জানা গেছে। শুরু থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ চললেও সংলগ্ন মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে পুলিশ কার্যত দর্শকের মতো দাঁড়িয়েছিল। ফলে নির্বিঘ্নে উভয় পক্ষ দলবল জুটিয়ে হামলা-পাল্টা হামলার সুযোগ ও সময় পেয়েছে। বিনোদপুর বাজারের ব্যবসায়ী, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা এমন অভিযোগ করেছেন। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার বগুড়া থেকে ইসলাম ট্রাভেলসের বাসে রাজশাহী আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী। বাসে সিটে বসাকে কেন্দ্র করে গাড়ির চালক ও সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় তার। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে এসে আবারও কন্ডাক্টরের সঙ্গে ঝামেলা বাধে। তখন স্থানীয় এক দোকানদার এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তর্কে জড়ান। এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুরো সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ভূমিকাই নেয়নি। ফলে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে বিনোদপুরের স্থানীয়রা সংঘবদ্ধ হয়ে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থানরত ছাত্রদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়। বিষয়টি সুরাহার জন্য রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয়রা তার মোটরসাইকেলেও আগুন ধরিয়ে দেয়। তখনো পুলিশ কোনো ভূমিকা নেয়নি। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সমানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ চললেও পুলিশ একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে বলে অভিযোগ উঠেছে।

রেললাইনে আগুন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ রেললাইনের ওপর টায়ার ও টিউবে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে। একপর্যায়ে রেললাইনের পাত খুলে ফেলেন তারা। এ ঘটনায় রাজশাহী-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ সংলগ্ন রেললাইনে এই ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে রাত ১১টায় দিকে তারা চলে যান। এ ব্যাপারে বোয়ালিয়া থানার উপ-পুলিশ কমিশনার আরেফিন জুয়েল বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র রেললাইনে আগুন দিয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এরপর আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আসি। কিন্তু এখানে এসে কোনো ছাত্রকে দেখতে পাইনি। তারা রেললাইনের ওপরে কাঠে আগুন দিয়েছিল। সেটা আমরা নিভিয়ে দেই। রাতে নিরাপত্তার জন্য এখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে-যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ব্যতীত আমরা ক্যাম্পাসের ভিতরে প্রবেশ করব না।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়ে মেডিকেলে ভর্তি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব। আমরা এই ঘটনার বিচার চাই। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।

ট্রেন চলাচলের ব্যাপারে পশ্চিম রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) অসিম কুমার তালুকদার বলেন, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ সংলগ্ন রেললাইনে টায়ার ও টিউবে আগুন জ্বালিয়ে অবস্থান নেওয়ার কারণে রাজশাহীর সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ আছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি পেলে ট্রেন যোগাযোগ আবারও চালু করা হবে। যাত্রীরা চাইলে ট্রেনের টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিতে পারবেন বলেও জানান তিনি।

এদিকে হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে আমরণ অনশনে বসেছেন আট শিক্ষার্থী। গতকাল সন্ধ্যা থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এই অনশন শুরু করেন তারা।

অনশনরত দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রাবেয়া মুহিব বলেন, আমরা সাতটি দাবি নিয়ে এখানে অবস্থান নিয়েছি। আমরা প্রশাসনের মুখের কথায় আশ্বস্ত হতে চাই না। আমরা দাবির বাস্তবায়ন চাই। আমাদের দাবিসমূহ মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের অনশন চালিয়ে যাব।

দাবিগুলো হলো- গতকালের ঘটনার জন্য প্রক্টরের পদত্যাগ ও প্রশাসনের জবাবদিহি, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ভার প্রশাসনকে নিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়কে শতভাগ আবাসিক করতে হবে এবং এ বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে, পাসকার্ড ব্যতীত বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে, ক্যাম্পাসের রিকশা ভাড়া, ডাইনিং ও খাবার হোটেলগুলোতে খাবারের দাম নির্ধারণ ও মান নিশ্চিতকরণ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশন পুনরায় চালু করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর