বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিদিন শুভ কামনা

তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশ প্রতিদিন শুভ কামনা

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকীতে এর প্রকাশক, পাঠক, সাংবাদিক, সম্পাদক সবাইকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক শুভ কামনা। এই পত্রিকাটি আমার কাছে খুব মূল্যবান কারণ বাংলাদেশের অন্য সমস্ত পত্রিকা যখন আমাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, এই পত্রিকাই আমাকে সুযোগ দিয়েছে স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করার। নির্বাসনের দীর্ঘ একটি সময় বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমি কলাম লিখেছি। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন আমি বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমে ব্রাত্য, কেন নিষিদ্ধ, কেন কালো তালিকাভুক্ত? একটিই কারণ, আমি রক্ষণশীল, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, নারীবিদ্বেষী লোকদের চক্ষুশূল। সমাজে যেহেতু রক্ষণশীল, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, নারীবিদ্বেষীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে, তখন খুব স্বাভাবিক যে তাদের চক্ষুশূলকে সমাজের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইবে নামিদামি মিডিয়া। বাংলাদেশ প্রতিদিন নামিদামি হলেও হিপোক্রেট নয়, সে কারণেই আমাকে আমার মতো করে কথা বলতে দিয়েছে।

বলা বাহুল্য, আমার শত্রুদের মধ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা আমার লেখা পড়েনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক প্রকাশক আমার মতের সঙ্গে একমত না হলেও আমার মত প্রকাশে বাধা দেননি, এখানেই তাঁদের মহত্ত্ব। পত্রিকায় যদি নানা রকম মত না থাকে, তাহলে সেটি হয়ে ওঠে কোনও একটি গ্রুপের মুখপত্র। সেটি আর জনসাধারণের পত্রিকা নয়। বাংলাদেশ প্রতিদিন জনপ্রিয় মত যেমন প্রকাশ করে, একই রকম গুরুত্ব দিয়ে ভিন্নমতও প্রকাশ করে। সে মতের সঙ্গে তারা নিজেরা একমত না হলেও করে। সে কারণেই অন্য সব পত্রিকা থেকে এই পত্রিকাটি আলাদা।

বাংলাদেশ প্রতিদিনে লেখা আমার কলামগুলো পড়ে শুনেছি অনেক তসলিমাবিরোধীর বোধোদয় হয়েছে। তারা গুজব শুনেছিল আমি শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে লিখি, আমি মেয়েদের উপদেশ দিই দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে, প্রকাশ্যে সিগারেট খেতে, উলঙ্গ ঘুরে বেড়াতে, যার তার সঙ্গে শুয়ে বেড়াতে। গুজবে বিশ্বাস করার লোক কম নয় দেশে। কিন্তু আমার লেখা পড়ার পর অনেকের ভুল ভেঙেছে। ঘটে বোধ বুদ্ধি যাদের অবশিষ্ট ছিল কিছু, তারা এখন শত্রু খাতা থেকে নিজেদের নাম কাটিয়ে নিচ্ছে। তারা আমার লেখা গোপনে হলেও পছন্দ করছে। প্রকাশ্যে এখনও হয়তো অনেকেই সাহস পাচ্ছে না আমার পক্ষে দাঁড়াতে। দেশে আমার ভাবমূর্তি, প্রচুর লোকের মধ্যে না হলেও কিছু লোকের মধ্যে, অনেকটা না হলেও, কিছুটা হলেও তো বদলাতে পেরেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন; এ কারণে পত্রিকাটির সম্পাদক এবং প্রকাশকের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।

আপাতত আমি কলাম লিখছি না পত্রিকাটিতে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আমি আপন বলে ভাবছি না, বা এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিজের লোক বলে ভাবছি না তা কিন্তু নয়। একবার যে উপকার করে, আমি তার উপকারের কথা ভুলি না। ভুলি না বলেই তাকে হৃদয়ে রাখি। প্রতিদিন তার যে কোনও প্রয়োজনে প্রতিদিন আমাকে কাছে পাবে। এটি প্রতিদিনকে দেওয়া আমার অলিখিত প্রতিশ্রুতি।

পত্রিকাটি হাতে নিয়ে পড়ার সুযোগ নেই আমার। অনলাইনে পড়তে হয়। আজকাল অনলাইনেই বেশির ভাগ খবর পড়ি। মাঝে মাঝে আমার আশংকা জন্মায় ভবিষ্যতে কোনও কাগজে ছাপা পত্রিকা হয়তো আমরা দেখবো না। পত্রিকাগুলো হয়ে উঠবে একশো ভাগ অনলাইন পত্রিকা। বইও হয়তো আর বের হবে না। ইলেকট্রনিক-বই-ই সর্বত্র বিকোবে। আমরা হয়তো সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি দুটো সময়ের। আমি অতীতকে আঁকড়ে পড়ে থাকার লোক নই, অতীতকে যেমন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, ভবিষ্যৎকেও স্বাগত জানাই। আজও আমি কাগজের পত্রিকা কিনে পড়ি, কাগজের বই কিনে পড়ি। কিন্তু কাগজের পত্রিকা কেনার সুযোগ না থাকলে আমি অনলাইনে পত্রিকা পড়তে আপত্তি করি না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন শুধু শিক্ষিত এলিট শ্রেণির পড়ার কাগজ নয়। এটি গরিব-ধনী, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, আস্তিক-নাস্তিক, কম-বয়সী বেশি-বয়সী, রক্ষণশীল প্রগতিশীল সবার পড়ার জন্য। সর্বস্তরের মানুষের প্রিয় হয়ে ওঠা আর আস্থা অর্জন করা যতটা সহজ ভাবা হয়, ততটা নয়। ঢাকা থেকে একবার এক বন্ধু আমাকে একটা ফটো পাঠিয়েছিল, রাস্তায় বসে এক মুচি জুতো সেলাইয়ের ফাঁকে খুব নিবিষ্ট মনে বাংলাদেশ প্রতিদিনে বের হওয়া আমার কলাম পড়ছে। কী যে ভালো লেগেছিল আমার! কোনও অফিস-বস তার রিভলভিং চেয়ারে বসে বাংলাদেশ প্রতিদিন পড়ছে-এর চেয়ে মুচির পড়ার দৃশ্যটি আমাকে আলোড়িত করেছে বেশি। আমি তো চিরকাল অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, সুবিধে-বঞ্চিত মানুষের কাছে পৌঁছোতে চেয়েছি, যেহেতু তাদের বঞ্চনার কথাই আমি বেশি লিখি।

আজ যদি দেশে থাকতাম, সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারতাম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসবে। কিন্তু অতটা সৌভাগ্য নিয়ে তো আমি জন্মাইনি। তাই দূর থেকেই আমি শুভকামনা পাঠাচ্ছি। সুস্থ এবং সুন্দর থাকুক প্রতিদিনের সকল কর্মী। বাংলাদেশ প্রতিদিন দীর্ঘজীবী হোক। আরও জনপ্রিয় হোক। আরও সফল হোক, সমৃদ্ধ হোক। মাঝে মাঝে ছবিতে দেখি বিশাল কেক কাটা হচ্ছে প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। সত্যি বলতে, আমি কোনওদিন আমার জীবনে অত বড় কেক দেখিনি। কত যে আমার ইচ্ছে করে ওই বিশাল কেকের এক টুকরো খেতে। সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। জীবনের কত আনন্দ থেকে যে আমি বঞ্চিত। দেশে প্রবেশ করা এবং বাস করার অধিকার না-পাওয়ার, সমাজকে সুস্থ সুন্দর করে গড়তে গিয়ে ব্রাত্য হওয়ার, খামোকা চক্ষুশূল হওয়ার, লোকের ঘৃণা পাওয়ার, নিন্দে শোনার, কোনও অপরাধ না করেও শাস্তি পাওয়ার, অন্যায়, অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার হওয়ার দুঃখ যদি অন্যের সঙ্গে ভাগ করা যেত, তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতাম। কিন্তু দুঃখ একা পোহাতে হয়। মানুষ আনন্দের ভাগ চায়, দুঃখের ভাগ নয়। এ সত্য আমি জীবন দিয়ে জেনেছি।

না, আজ আর দুঃখের নয়, শুধু উৎসবের কথা হোক। প্রতিদিনের বাগানে লক্ষ গোলাপ ফুটুক। বাতাসে সুগন্ধ ভাসুক।

 

সর্বশেষ খবর