শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

রমজানের চাঁদে ঝরে তাকওয়ার জোছনা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রমজানের চাঁদে ঝরে তাকওয়ার জোছনা

সন্ধ্যার আকাশে এক ফালি বাঁকা চাঁদ। কি মায়াবি আর রূপে ঘেরা সেই চাঁদখানা। দুনিয়ার মুমিন-মুসলমানরা দেখেই খুশিতে আটখানা। হ্যাঁ ঠিক অনুমান করেছেন, গতকাল সন্ধ্যায় ওঠা মাহে রমজানের হাসিমাখা চাঁদের কথাই বলছি। ওই চাঁদই তো ইবাদতের মাস রমজানে প্রবেশের প্রথম চিহ্ন। এ চাঁদের জন্যই নবীজি (সা.) অধীর অপেক্ষায় থাকতেন। দুই মাস আগে থেকেই রজবের চাঁদ দেখে রমজানের চাঁদের জন্য দোয়া করতেন। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে বহুল প্রত্যাশিত মাহে রমজানের বাঁকা চাঁদ। আমরা পৌঁছে গেছি অফুরন্ত কল্যাণ ও বরকতের দরিয়ায়। রমজানের চাঁদ দেখেই রসুল (সা.) সাহাবিদের এ মাসের মাহাত্ম্য সম্পর্কে সজাগ করে দিতেন। একটি মুহূর্তও যেন কারও অপচয় না হয়, অবহেলা-অযত্নে না কাটে- খুব দরদের সঙ্গে নসিহত করতেন। হাদিস শরিফের বর্ণনা থেকে জানা যায়, রসুল (সা.) একবার মাহে রমজানের চাঁদ দেখে মসজিদে একটি খুতবা দিলেন। সেই খুতবায় বড় আবেগি ভাষায় নবীজি বলেছেন, ‘হে উপস্থিত আমার সাহাবায়ে কেরাম! তোমরা জেনে রাখ, আজ সন্ধ্যায় চাঁদ ওঠার সঙ্গে পৃথিবীবাসী এক বরকতময় মাসে প্রবেশ করেছে। সে মাস হলো মাহে রমজান। এ মাসে জান্নাতের দুয়ার খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দুয়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাসজুড়ে কবরবাসীর শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা হয়। খুব ভালো করে শোন! এ মাসে একটি রাত আছে, যে রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’ (মিশকাত শরিফ।) হাদিসে বলা সেই মর্যাদাবান রাতটি হলো কোরআন নাজিলের বরকতময় রাত। রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে কোরআন নাজিল হয়েছে। এ ঘটনার মাধ্যমে নবীজির নবুয়াত প্রকাশিত হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, অনেকেই বলেন নবীজি (সা.) লাইলাতুল কদরে নবুয়াত পেয়েছেন। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। বরং ওইদিন হুজুরের নবুয়ত প্রকাশিত হয়েছে। নবীজি (সা.) তো আদম (আ.) এর জন্মের বহু আগে থেকেই নবী ছিলেন। রমজান মাসে কোরআন নাজিল হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলছেন, ‘শাহরু রাদানাল্লাজি উনজিলা ফিহিল কোরআনি হুদাল্লিন্নাসি ওয়া বায়্যিনাতিম মিনাল হুদা ওয়াল ফোরকান। রমজান মাসে মানুষের পথনির্দেশনা এবং সত্য- মিথ্যার পার্থক্যকারী পবিত্র কোরআন নাজিল করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত ১৮৫।) কোরআন নাজিল এবং রসুল (সা.) এর নবুয়াতি লাভের কারণে মাহে রমজানের মর্যাদা এতই বেড়ে গেছে যে, এ মাসে একটি নফল ইবাদত একটি ফরজ ইবাদতের মর্যাদা লাভ করে এবং একটি ফরজ ইবাদত সত্তরগুণ বেশি বিবেচনা করা হয়। রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মাঝে এক বরকত-কল্যাণময় মাস এসেছে। যারা কল্যাণ লাভ করতে চাও দৌড়ে এসো। এ মাসে একটি নফল আমল ফরজের মর্যাদা পায় এবং একটি ফরজ সত্তরটি ফরজের মর্যাদা পায়।’ (সুনানে বায়হাকি শরিফ)। হিজরি বর্ষের নবম মাস রমজানের নামকরণ ভাষাবিদরা বলেন, আরবি ‘রমদ’ ধাতু থেকে রামাদান বা রমজান শব্দটি এসেছে। রমদ অর্থ ‘অতিরিক্ত গরম’। প্রাচীন আরবরা যখন মাসের নাম নির্ধারণ করছিলেন, ওই সময় গ্রীষ্মকালের নাম রাখেন রমজান বা অতিরিক্ত গরমের মাস। সেই থেকেই এ মাসটির নাম ‘রমজান’ নির্ধারিত হয়ে যায়।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ)। বিখ্যাত আরবি অভিধান লিসানুল আরবে বলা হয়েছে- প্রচ গরম বা উত্তাপ বোঝাতে রমদ শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন ‘রমদুস সায়েম। রোজাদারের পেট প্রচ গরম হয়ে উঠেছে।’ তা ছাড়া যেহেতু রমজান মাসে বান্দার গুনাহ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়, এ কারণেও এ মাসটির নাম রমজান হওয়া যথোপযুক্ত হয়েছে। (লিসানুল আরব)। তাফসিরে কুরতুবিতে ইমাম কুরতুবি (রহ.) লিখেন, ‘আরবি সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা বা ছেড়ে দেওয়া। বাহ্যিকভাবে সিয়াম পালন করতে হলে বান্দাকে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো মন্দ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। আর এটাই কোরআনে বলা সিয়াম সাধনার প্রাথমিক স্তর। সবর্বোচ্চ স্তর হলো চিরতরে গুনাহ ছেড়ে দেওয়া বা বর্জন করা।’ (তাফসিরে কুরতুবি)। বান্দা যখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজেকে গুনাহ থেকে ফিরিয়ে রাখার কঠোর সাধনা করবে এবং এক মাস এভাবে জোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, আশা করা যায় মাস শেষে সে মুমিন থেকে মুত্তাকির স্তরে উপনীত হবে। সিয়াম সাধনার মূল টার্গেটও তাই। সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘লাআল্লাকুম তাত্তাকুন। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আশা করা যায় তোমরা মুত্তাকি হয়ে উঠবে।’

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর