মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বর্ণাঢ্য বিদায় আবদুল হামিদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

বর্ণাঢ্য বিদায় আবদুল হামিদের

বঙ্গভবন থেকে গতকাল বর্ণাঢ্য বিদায় মো. আবদুল হামিদের -পিআইডি

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অধ্যায় শেষ হলো। একক ব্যক্তি হিসেবে টানা ১০ বছর ৪১ দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ইতিহাস সৃষ্টি করে গতকাল বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে বিদায় নেন তিনি। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রীয় বিদায় জানাল বঙ্গভবন। এর আগে বঙ্গভবনে এমন কোনো বিদায় অনুষ্ঠান হয়নি। কারণ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আগে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মতো মসৃণ পরিবেশ ছিল না।

শুধু বাংলাদেশ নয়, এ উপমহাদেশে দীর্ঘ ১০ বছর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মো. আবদুল হামিদ এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। বলা যায়, সৌভাগ্যের বরপুত্রও তিনি। দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন বঙ্গভবনের ৫২ বছরের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত।

গতকাল একটি পূর্ণ মোটর শোভাযাত্রায় আবদুল হামিদের রাষ্ট্রীয় ‘প্রটোকল’ শেষ হয়। এরপর তাঁকে আবার ট্রাফিক লাইট এবং মোড়ে থামার অভ্যাস করতে হবে। আবদুল হামিদ রাজধানীর নিকুঞ্জে নিজ বাসা ‘রাষ্ট্রপতি লজে’ থাকবেন। সেখানে পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী স্থানান্তর করা হয়েছে।

তৃণমূল থেকে গড়ে ওঠা কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়া আবদুল হামিদ আর সক্রিয় রাজনীতি করবেন না। তিনি লেখালেখি করবেন এবং তাঁর প্রাণের এলাকা হাওরের মিঠামইনে যাবেন।

গতকাল দুপুরে বঙ্গভবনে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। এ সময় তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এর আগে বেলা ১১টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। নতুন রাষ্ট্রপতিকে শপথ পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তারপর চেয়ার বদলের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা সারেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। কিছুক্ষণ পর বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল মাঠে শুরু হয় তাঁর বিদায় পর্ব। দুপুর ১টার পর শুরু হওয়া এ বিদায় অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের সুসজ্জিত একটি দল বিদায়ী গার্ড অব অনার দেয় আবদুল হামিদকে। এরপর তিনি লাল গালিচায় হেঁটে গার্ড পরিদর্শন করেন। গার্ড অব অনার পর্ব শেষে আবদুল হামিদ ও তাঁর সহধর্মিণী রাশিদা খানম ওঠেন ফুল দিয়ে সাজানো একটি খোলা জিপে। বঙ্গভবনের কর্মীরা দুই সারিতে লাল কাপড়ে মোড়ানো দুটো রশি ধরে এগিয়ে যান প্রধান ফটকের দিকে। সেই রশি বাঁধা পুষ্পশোভিত প্যারেড কারে। সেখানে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানান আবদুল হামিদ ও তাঁর স্ত্রী রাশিদা খানম। দুই পাশ থেকে তখন চলছিল পুষ্পবৃষ্টি। আবদুল হামিদ হাত নেড়ে জবাব দেন অভিবাদনের। তাঁর আগে বাংলাদেশে ২০ জন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের কেউ কার্যত আনুষ্ঠানিক বিদায় পাননি।

খোলা জিপটি বঙ্গভবনের মূল ফটকে পৌঁছালে আবদুল হামিদ ও রাশিদা খানম একটি কালো রঙের গাড়িতে ওঠেন। সেখানে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের তত্ত্বাবধানে মোটর শোভাযাত্রা করে তারা পৌঁছান নিকুঞ্জে তাঁদের বাড়ি ‘রাষ্ট্রপতি লজে’।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবদুল হামিদ পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। এর আগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন তিনি। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালের ২০ মার্চ আবদুল হামিদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। পরে আবদুল হামিদ ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

রাষ্ট্রপতি হামিদ ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আবদুল হামিদ নবম সংসদে স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। আবদুল হামিদ এর আগে ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার পর থেকে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

বিদায় বেলায় যা বললেন আবদুল হামিদ : গতকাল বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান শেষে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আমি স্পিকার ছিলাম। এখানে আসার ইচ্ছা ছিল না, আমি এসেছি আর কি। আমি পার্লামেন্টে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। ওখানে নিজেকে মুক্ত মনে হতো। আমি জানতাম, এখানে (বঙ্গভবনে) এলে অনেকটা বেড়াজালের মধ্যে পড়ে যাব। যাই হোক, তবু ১০ বছর পার করে ফেলেছি।

সাংবাদিকদের তাঁর কাছে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, আসবেন সময়ে সময়ে প্রাণ খুলে মন খুলে আলোচনা করব।

রাজনীতি করার ইচ্ছা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনীতি করা, এটা আমার পরিকল্পনায় নেই। দেশের মানুষ আমাকে এত বড় ইজ্জত দিয়ে মন খুলে দুই মেয়াদে আমাকে রাষ্ট্রপতি করেছে। সুতরাং আবার আমি রাজনীতি করব, আবার অন্য কোনো পদে যাব- এসব করলে আমার মনে হয় এ দেশের মানুষকে আমি হেয় করব। সেটা আমি করব না।

বাকি জীবন কী করবেন, সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, আমি তো রিটায়ার্ড হয়ে গেছি। রিটায়ার্ড মানে দোজ হু আর টায়ার্ড। বাড়ি বসে লেখালেখি করতে পারি।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তরুণ রাজনীতিকদের প্রতি নিজের পরামর্শও তুলে ধরেন আবদুল হামিদ। নিজের রাজনৈতিক জীবনের কথা তুলে ধরে বলেন, সারা জীবন রাজনীতি মানুষের জন্য করেছি। মানুষের বাইরে আর কোনো চিন্তা ছিল না, থাকবেও না। সব রাজনীতিবিদকে এ কথাই বলব, দেশের মাটি ও মানুষের কথা ভেবে যেন রাজনীতি করেন। তাহলে রাজনীতি অনেক সুন্দর হবে। সেটাই দলমতনির্বিশেষে সবার কাছে আশা করি। তিনি বলেন, নতুন রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করবেন, এটাই জাতির প্রত্যাশা।

বঙ্গভবন ছেড়ে নিকুঞ্জে পৌঁছে রাষ্ট্রপতি লজে প্রবেশের আগে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আরেক দফা কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন আবদুল হামিদ। রোদের মধ্যে কষ্ট করে গাড়িবহরের সঙ্গে আসায় সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তিনি বলেন, আপনাদের অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আজকের দিনে আমার যেটুকু সফলতা, এজন্য পুরো দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার প্রতি দেশবাসীর দোয়া ছিল। আমার জেলা, আমার এলাকার মানুষেরও দোয়া ছিল আমার প্রতি। বিশেষ করে আপনাদের (গণমাধ্যম) প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় আমি যা-ই বলেছি, আপনারা প্রকাশ করে মানুষের মধ্যে তুলে ধরেছেন, এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তা ছাড়া আজকে আমি এটাও বলতে চাই। প্রধানমন্ত্রী আমাকে মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন, বা আমার কাজের ব্যাপারে কোনোরকম বাধার সৃষ্টি হয়নি; এজন্য তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

নিজের ভাষায় ‘অবসরে যাওয়া’ আবদুল হামিদের আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে, সেই আভাসও তিনি দেন। ভাটির শার্দূল খ্যাত এই রাজনীতিক বলেন, আমার বেশির ভাগ ইচ্ছা হাওর এলাকায় থাকার। ঢাকায়ও থাকতে হবে। আমার রাজনীতির চারণভূমি কিশোরগঞ্জেও সময় দেব। সময়টাকে আমি তিনটা ভাগে ভাগ করতে চাই- ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও হাওর এলাকা। চেষ্টা করব হাওর এলাকায় বেশি থাকার।

ভবিষ্যতে দেশে ‘সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা’ দেখার প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, আমি আশা করি অদূর ভবিষ্যতে দেশে একটা সুষ্ঠু, স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরও এগিয়ে যাবে। সব দিক থেকে এ দেশের মানুষ ভালো থাক।

অবসরকালে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবেন আবদুল হামিদ : অবসরে গেলেও আইন অনুযায়ী অবসর ভাতা, চিকিৎসা সুবিধাসহ অন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবেন আবদুল হামিদ।

রাষ্ট্রপতির অবসর ভাতা, আনুতোষিক অন্যান্য সুবিধা আইনের তথ্যে বলছে : কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে কমপক্ষে ছয় মাস দায়িত্ব পালন শেষে পদত্যাগ করলে অথবা মেয়াদ শেষ হলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বশেষ যে মাসিক বেতন পেতেন, তার ৭৫ শতাংশ হারে মাসিক অবসর ভাতা পাবেন।

‘দ্য প্রেসিডেন্টস (রেমিউনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস) অ্যাক্ট’ অনুযায়ী বর্তমানে রাষ্ট্রপতির মাসিক বেতন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ হিসেবে অবসরের পর আবদুল হামিদ মাসে ৯০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন।

আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে অন্য কোনো চাকরি বা পদ থেকে অবসরে গিয়ে অবসর ভাতা গ্রহণ করলে তিনি ওই অবসর ভাতা এবং রাষ্ট্রপতির অবসর ভাতার মধ্যে তার ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো একটি পাওয়ার যোগ্য হবেন। রাষ্ট্রপতি অবসর ভাতা গ্রহণ করে মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী অথবা ক্ষেত্রমতে বিপত্নীক স্বামী তার প্রাপ্য অবসর ভাতার দুই-তৃতীয়াংশ হারে আমৃত্যু মাসিক ভাতা পাবেন।

অবসর ভাতা গ্রহণের প্রাধিকার অর্জন করা সাবেক কোনো রাষ্ট্রপতি অবসর ভাতার পরিবর্তে আনুতোষিকও (এককালীন অর্থ) গ্রহণ করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি ছয় মাসের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় আনুতোষিক পাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত না করে অথবা অবসর ভাতা গ্রহণ না করে মারা গেলে তিনি আনুতোষিক পাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন বলে গণ্য হবে। তখন আনুতোষিকের টাকা মনোনীত ব্যক্তি অথবা উত্তরাধিকারীরা পাবেন। সরকারি অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিনামূল্যে সরকারি যানবাহন ব্যবহার, আবাসস্থলে একটি টেলিফোন সংযোগ পাবেন। সরকার সময়ে সময়ে নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত এর বিল পরিশোধ থেকে অব্যাহতি দেবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে একটি কূটনৈতিক পাসপোর্টও পাবেন মো. আবদুল হামিদ। তিনি দেশের ভেতর ভ্রমণকালে সরকারি সার্কিট হাউস বা রেস্ট হাউসে বিনা ভাড়ায় অবস্থানেরও সুবিধা পাবেন।

এ ছাড়া আইন অনুযায়ী অবসরে যাওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে অন্য কিছু সুবিধাও পাবেন মো. আবদুল হামিদ। তিনি একজন ব্যক্তিগত সহকারী ও একজন অ্যাটেনডেন্ট (সাহায্যকারী) পাবেন। দাফতরিক ব্যয়ও পাবেন। যার মোট বার্ষিক পরিমাণ সময়ে সময়ে সরকার নির্ধারণ করবে। একজন মন্ত্রীর প্রাপ্য চিকিৎসা সুবিধার সমপরিমাণ সুবিধাও পাবেন সদ্যসাবেক এই রাষ্ট্রপতি।

সর্বশেষ খবর