বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকারে আবদুল হামিদ

সংকট আছে, আলোচনাই সমাধান

♦ আমি রাষ্ট্রপতি হতে চাইনি, কিন্তু হতে হয়েছে ♦ আমার এখান থেকে কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে যেতে পারেনি

জাহাঙ্গীর আলম

সংকট আছে, আলোচনাই সমাধান

সদ্য অবসর নেওয়া রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, রাজনীতিতে স্পষ্টতই কিছু সংকট প্রতীয়মান হচ্ছে। সরকার বলছে, সংবিধানের বাইরে যাবে না। বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে আসবে না। এখানে সংকট তো আছেই। সংকট দেখলেও আবদুল হামিদ সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন। তাঁর মতে, আলোচনাই সমাধানের একমাত্র পথ। এক্ষেত্রে সব দলকে (সরকার ও বিরোধী দল) আন্তরিক হতে হবে।

গত শুক্রবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির চেম্বারে বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ তিনটি জাতীয় দৈনিকের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। এ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। বলা যায়, রাষ্ট্রপতি হিসেবে এটাই তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার।

ঘণ্টাখানেকের আলোচনায় আবদুল হামিদ কিছু কথা স্বতঃস্ফূর্ত বলেছেন, কিছু কথা প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন। কথাবার্তায় ছিলেন খোলামেলা ও আন্তরিক। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে অতীতের নানা দিক তিনি আলোকপাত করেন। স্পষ্টতই তাঁর মধ্যে ছিল সন্তুষ্টি এবং জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আবদুল হামিদ বলেন, সরকার ও বিরোধী দল যার যার অবস্থান নিয়ে আছে। কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, আবার কেউ না-ও নিতে পারে। বা এর মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। সংকট তো আছেই একটা। উত্তরণের পথ হিসেবে তিনি বলেন, আলোচনাই একমাত্র সমাধান। আর কোনো পথ নাই। আলোচনা না হলে তো কিলাকিলি। তাই সরকারি ও বিরোধী দলকে আন্তরিক হতে হবে। আন্তরিক আলোচনায় সংকটের সমাধান হবে না এমনটা আমি মনে করি না। তিনি বলেন, প্রশ্ন একটাই। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। মানুষ অবাধে ভোট দেবে, কোনো জোরজবরদস্তি হবে না, এরকম গ্যারান্টি...। এরপরও যদি বিরোধী দল বলে আমরা নির্বাচনে আসব না, তাহলে বুঝতে হবে তাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে। আর সরকার যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন না করে তাহলেও বুঝতে হবে তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। কারোরই এমন উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়।

সংকট উত্তরণে দুই দিক থেকেই মধ্যস্থতা করার অনুরোধ এলে তৈরি থাকবেন কি না জানতে চাইলে আবদুল হামিদ বলেন, এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত এখনো পাইনি। যদি বুঝি এমন কিছু হবে, যদি সরকার নিশ্চয়তা দেয় তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করবে, আর বিরোধী দলও যদি সংবিধানের ভিতর থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পায় তাহলে তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। এখানে উভয়কে ছাড় দিতে হবে। তা না হলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে চীন, রাশিয়া থেকে যে কেউ এলেও এটা সম্ভব নয়। রাজনীতিকদের বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, এটা একটা দেউলিয়াপনা। কোনো অবস্থাতেই এটা ঠিক না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করা উচিত। ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো দেশে সংকট দেখা দিলে তো আমাদের দাওয়াত দেয় না। সরকার বা বিরোধী দল কারোরই বাইরের সহযোগিতা চাওয়া ঠিক না। তাহলে আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম দেশটা প্রশ্নবোধক হয়ে যায়।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বের ১০ বছরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কঠিন সময় এসেছিল কি না জানতে চাইলে আবদুল হামিদ বলেন, কঠিন-জটিল কোনো বিষয় না, এটাকে আমি সহজভাবে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। দু-একটা ঘটনা যে ঘটেনি, আমার মনের বিরুদ্ধে... এমনটা হতেই পারে। কিন্তু খুব বেশি কাজ হয়নি। আমি যে কোনোভাবে ম্যানেজ করেছি। সংকট যেগুলো এসেছে চেষ্টা করেছি সুন্দরভাবে মোকাবিলার। যেমন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার যে ঘটনাটা ছিল, আমি যেভাবে সমাধান করেছি, এটা অত্যন্ত কঠিন ছিল, সরকারের ওপর কোনো আঁচ লাগতে দিইনি। এমন টেকনিক করলাম, তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আবদুল হামিদ বেশ সন্তুষ্টি নিয়েই বললেন, আমি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর একবার খালেদা জিয়া এসেছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়। তাঁরা কেউ আমার এখান থেকে অসন্তুষ্ট হয়ে যেতে পারেননি।

বর্তমান সময়ের রাজনীতি নিয়ে আবদুল হামিদের কিছুটা মনোবেদনার কথাও জানান। স্পষ্টতই তিনি বলেন, রাজনীতি নিয়ে আমি সংসদে কিছু কথা বলেছি। আমি কী চাই তা সেখানে আছে। আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ‘এমএনএ’ এবং ‘এমএলএ’র মধ্যে শতকরা ৫১ ভাগ অ্যাডভোকেট পেশার ছিলেন। এরপর ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক এবং সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। ব্যবসায়ী ‘এমএনএ’ এবং ‘এমএলএ’ শতকরা ২-৩ ভাগের বেশি ছিলেন না। এখন তো আপনারা নিজেরাই লেখেন এবং দেখেন এমপিদের মধ্যে ৬২ ভাগ ব্যবসায়ী। আরও দুঃখজনক হলো, অনেকে ব্যবসায়ী না হওয়া সত্ত্বেও এমপি নির্বাচিত হয়ে ব্যবসায়ী বনে যান। এটা আপনাকে ‘যন্ত্রণা’ দেয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই যন্ত্রণা দেয়। সামরিক-বেসামরিক আমলারা অবসরের পরই এলাকায় যান, এমপি হতে চান।

মনোনয়ন তো রাজনীতিকরাই দেন... বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে আবদুল হামিদ বলেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা দলের ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দেন। অন্যদিকে বিপরীত পক্ষ, বড় বড় জেনারেল, সচিব, ধনাঢ্য ব্যক্তি- এমন লোকদের মনোনয়ন দেয়। একমাত্র এ কারণেই ’৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া বিজয়ী হন, আর শেখ হাসিনা বিরোধী দলে যান। তাই ’৯৬ সালের নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনা ভাবলেন, যদি এমন কিছু না করেন তাহলে সারা জীবন বিরোধী দলেই থাকতে হবে।

তাহলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী জানতে চাইলে আবদুল হামিদ বলেন, ক্ষমতায় যাব এমন না, ভালো মানুষদের নিয়ে রাজনীতি করব, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি এ ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তাহলেই এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব। তাছাড়া আর কোনো পথ নেই।

এই দীর্ঘ কর্মজীবন শেষ হওয়ার লগ্নে কোনো প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি আছে কি না জানতে চাইলে সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি রাজনীতি করেছি দেশের কল্যাণের জন্য। পাশাপাশি আমার জেলা ছিল আমার রাজনীতির চারণভূমি। বিশেষ করে হাওর এলাকাটা খুবই অবহেলিত ও অনুন্নত। বর্ষকালে মানুষ মারা গেলে পানিতে ভাসিয়ে দিতে হতো। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্যাংক-বীমা-লাইসেন্স-পারমিট কিছুই চাইনি। যা চেয়েছি আমার এলাকার উন্নয়নের জন্য। হাওরে উন্নয়ন করা খুবই কঠিন। তারপরও আমি মনে করি, কিছুটা হলেও করতে পেরেছি। পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও মোটামুটি বা আংশিক সন্তুষ্ট আমি। যেহেতু ট্র্যাকে উঠেছে, এখন আস্তে আস্তে বোধ হয় সামনের দিক যাবে। তবে এটা অনেকটা নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ওপর।

অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ২৫ বছর বয়সে ‘এমএনএ’ হয়েছি। বেশ কয়েকবার ‘এমপি’ হলাম। ১৯৯৬ সালে ডেপুটি স্পিকার হয়েছি। এর আগে কিশোরগঞ্জের বাইরে আমার পরিধি ছিল না। কারণ কেন্দ্রীয় রাজনীতির প্রতি আমার আগ্রহ ছিল না। বলা যায়, কিশোরগঞ্জের রাজনীতির আমি সুপ্রিম কমান্ডার ছিলাম। এমনকি বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকেও আমি চালিয়েছি। তিনি বলেন, ডেপুটি স্পিকার, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা, স্পিকার, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলাম। আমি রাষ্ট্রপতি হতে চাইনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতে হয়েছে। ভেবেছিলাম, পাঁচ বছর কোনোরকম বন্দি জীবন কাটিয়ে যাই। এর মধ্যে হয়ে গেল ১০ বছর। তিনি বলেন, দুবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিষয়টি সংবিধানে আছে। একটা গুঞ্জন ছিল, ‘এমপি’রাও বলেছিলেন, সংবিধান সংশোধন করার। যে সংবিধান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করেছি, দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি থাকার পর ব্যক্তিগত কারণে তা সংশোধন করে এ পদে থাকা ঠিক না। আর কথায় বলে, ‘মান থাকতে ভঙ্গ ভালা’। দেশবাসীর দোয়া নিয়ে ইজ্জতের সঙ্গে যাচ্ছি। আবার এমন না যে আর কোনো পদ-পদবিতে যাব। জনগণ সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছে। অন্য কোনো পদে যদি যাই তাহলে জনগণকে অপমান করা হবে। সুতরাং আমার এ ধরনের কোনো খায়েশ নেই। যে কয়দিন বাঁচি, সাধারণ জীবনযাপন করব। ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও গ্রামের বাড়ি হাওর এলাকা মিলিয়ে থাকব। তিনি বলেন, আমি মানুষকে ভালোবেসেছি, মানুষও আমাকে ভালোবেসেছে। আমি মনে করি, মানুষকে সত্যিকার ভালোবাসলে তাদের ভালোবাসা পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রপতির ১০ বছরে মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেননি, এটা যন্ত্রণার ছিল কি না জানতে চাইলে আবদুল হামিদ বলেন, আমি যখন বাড়িতে যাই তখন আমার ঘরের মানুষের সঙ্গেও কথা বলতে পারি না। কারণ আমার সঙ্গে ‘এসএসএফ’ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) থাকে। বাড়ির কোনো মহিলা কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন। অনেক কথা আছে এদের সামনে বলতে আমারও লজ্জা লাগে। সুতরাং রাষ্ট্রপতির ১০ বছরে আমার অবাধ মিথস্ক্রিয়া ছিল না। বলা যায়, এক ধরনের বন্দি জীবন ছিল। পাকিস্তান আমলে জেলে ছিলাম, জিয়াউর রহমানের আমলে জেলে ছিলাম, এটাও অনেকটা তাই... তবে পার্থক্য হলো এখানে অনেক শানশওকত আছে। স্যালিউট পাওয়া যায়। মানে একটা পোছপাছ আছে আর কি...। তবে এটাও বলতে চাই, আমি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর, বঙ্গবন্ধুর বিষয়টা ভিন্ন, তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না, এ ছাড়া বাকি যত রাষ্ট্রপতি ছিলেন, সব মিলিয়ে আমার সময়ে যে মানুষ বঙ্গভবনে এসেছে, তাদের সময়ে এর চার ভাগের এক ভাগ লোক এসেছে কি না জানা নাই। যতটুকু পারি তাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করেছি। রাত ১২টা, ১টা পর্যন্ত মানুষ ছিল। এটা নজিরবিহীন। কোনো রাষ্ট্রপতি রাত ১২টা, ১টা পর্যন্ত জনগণ নিয়ে বঙ্গভবনে কথা বলেননি। আমি এটা করেছি। কেবল করোনার তিনটি বছর কেউ আসতে পারেনি।

নতুন রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে কিছু বলার আছে কি না জানতে চাইলে আবদুল হামিদ বলেন, দেশবাসী নিশ্চয়ই তাঁর কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করেন, আমিও তাই চাই। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করবেন। এটাই প্রত্যাশা করি। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, জনগণের সহযোগিতা ও ভালোবাসা পেয়েছি। আমিও তাদের আন্তরিকভাবে ভালোবাসি। প্রতিদানও পেয়েছি। আই এম হ্যাপি। তিনি জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তারপর বলার মতো আর কোনো রাজনীতিক নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে আবদুল হামিদ বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী তো আছেনই। তারপর তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এটা আমার জন্য আরেকটা বিষয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী না হলেও সম্পর্ক এমনই থাকত। তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রী নন, তাঁর সঙ্গেও আমার সুন্দর সম্পর্ক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর